জালালউদ্দিন
ঘাট পাড়ে একটা টেবিলকে ঘিরে গোটা বিশেক মানুষের ছোটখাট একটা জটলা। তীব্র রোদে তপ্ত বালুর উপর দাঁড়িয়ে পশুর নদীর (মংলা) পাড় জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বালুভরাটের ড্রেজারগুলো গোনার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই চোখ ধাধিয়ে আসছিল।
হঠাৎ দেখলাম টেবিল ঘিরে জটলাটা আর নেই। কিছু মানুষ কোদাল হাতে ড্রেজারগুলোতে উঠছে আর বাকিরা ফিরে আসছে। কাহিনী কী?
উৎসুক মন নিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়া একজনকে ডাক দিলাম- ও ভাই, একটু দাঁড়ান। আমি ওনার কাছে গেলাম। জানতে চাইলাম- ওখানে কী হচ্ছিল। সে বলল, তারা প্রতিদিন সকালে এখানে আসে দিনমজুরি খাটার জন্য। কিন্তু ঘন্টায় মাত্র ৩০ টাকা হারের দিনমজুরির সুযোগও প্রতিদিন পাওয়া যায় না। অনেক সময় ঠিকাদারেরা আরও সস্তায় বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে আসে।
কথায় কথায় জানতে পারলাম তার নাম জালালউদ্দিন। তার বাবা প্রথম এখানে এসে স্থায়ী হয়। বাবার মৃত্যুর পর আট বিঘা জমি চার ভাইয়ের মধ্যে বিলিবন্টন হয়ে যায়। তার ভাগের দুই বিঘা আর হাড়িতে (জমি লীজ নেয়া) আরও পাঁচ বিঘা নিয়ে ফসল আর চিংড়ি চাষ করে বছর শেষে তার ভালই আয় হত। কিন্তু ২০১১ সালে তার দুই বিঘা জমি সরকারী নির্দেশে অধিগ্রহণ করে নেয়া হয়। প্রতি বিঘায় ১.৫ লক্ষ টাকা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। মাত্র চার মাস হল সে জমির টাকা হাতে পেয়েছে। এই টাকা তুলতে সবার মত তারও বিঘা প্রতি দশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
এক সময়ে বছরে কয়েক লক্ষ টাকা আয় করা জালালউদ্দিনের স্বভাবসুলভ হাত খরচে একটা বড় অংশই ব্যয় হয়ে গেছে। এই চার মাসে সে চেষ্টা করেছে প্রকল্প জায়গার বাইরে আশেপাশে কিছু জায়গা কিনতে। কিন্তু কথা বলতে বলতে তার কন্ঠে টের পাওয়া গেল ক্ষোভ আর হতাশা। এই প্রকল্প উন্নয়নের মধু খেতে আশেপাশের এলাকায় ইতোমধ্যেই এসে পড়েছে নামীদামী কয়েকটি ডেভোলপার কোম্পানী। চারপাশের জায়গা-জমি ওদের নিজস্ব কায়দায় দখল করছে আর জমি কিনতে গেলে বিঘা প্রতি দাম হাঁকছে ৫-৭ লক্ষ টাকা। জালালউদ্দিন তাই এখন আর জমি কিনে আবার চাষবাস শুরু করার স্বপ্ন দেখে না।
শহরে গিয়ে সে ব্যবসা শুরু করবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু আজীবন কৃষিকাজ করে আসা জালালউদ্দিন কার কাছে যাবে- কি ব্যবসা শুরু করবে- কোথায় টাকা খাটাবে তা নিয়ে দিশেহারা।
সহায় সম্বলহীন জীবন টেনে নেয়ার অনিশ্চয়তা যতটা তীব্রভাবে তার কথাবার্তায় ফুটে উঠেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু জালালউদ্দিনের উদাস চাউনীর শুন্য দৃষ্টিতে আমি ঠিকই তা দেখেছি।
>>> চাহিদার বাজারে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা ফুলবানু, ফরিদ গাজী আর জালালউদ্দিনের বেঁচে থাকার আকুতি মূল্যহীন। কিন্তু মানবিক দৃষ্টিতে রামপাল জনপদের প্রতিটি মানুষের জীবন সংকটে সাড়া না দিয়ে ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকাটা মনুষ্যত্বহীন।
বিদ্যুতের প্রয়োজনে কিন্তু উন্নয়নের অজুহাতে, সুশিলতার ভাবগাম্ভীর্যে রামপালে চলতে থাকা অন্যায়-অত্যাচার-শোষণ-নিপীড়ন কিভাবে মেনে নেয়া সম্ভব!!
এ কেমন উন্নয়ন যার বিনিময় মূল্য ফজলু মিয়ার জীবন?
এ কেমন উন্নয়ন যার বিনিময় মূল্য আমাদের অহংকারের সুন্দরবন?
এ কেমন উন্নয়ন যার বিনিময় মূল্য লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন ধ্বংসের আয়োজন?
##রামপালে ফুলবানু নেই। আছে অন্যকেও। ঠিক তেমনি ফরিদ গাজী আর জালালউদ্দিনও নেই, আছে অন্যকেও। আমি চাই না প্রকৃত নাম পরিচয় প্রকাশ করে এই জীবনগুলিতে নতুন আর কোন উপদ্রবের সৃষ্টি করতে। আমার বর্ণনায় রামপাল তাই ছদ্মনামের জনপদ হিসেবেই বেঁচে থাকুক।
————-
-Mowdudur Rahman
←রামপালঃ ছদ্মনামের জনপদ -১ (ফরিদ গাজী)
←রামপালঃ ছদ্মনামের জনপদ -২ (ফুলবানু)