অপরূপ সুন্দর আমাদের সুন্দরবন। শুধু সুন্দর আর অপরূপ নয় দেশের দক্ষিন-পূর্বের মানুষের জীবন-জীবিকা বা জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার নামও সুন্দরবন। আর এর প্রমান মিলেছিল প্রলয়ংকারী সিড়র বা আইলাতে। সে দিন এ অঞ্চলের মানুষের শেষ ভরসা হয়েছিল সুন্দরবন। কিন্তু আজ মানুষের তান্ডবে প্রাণ-হাসফাস আবস্থা সুন্দরবনের। ২০১১ সালে যেখানে এ অঞ্চল দিয়ে জাহাজ ও কার্গো চলত ২৫টি। আজ ২০১২ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩০-এ। আগে জাহাজ নোঙর করত মংলায়। কিন্তু এখন সুন্দরবনের ভেতরের তিনটি স্থানে জাহাজ নোঙর করছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে সুন্দরবনের চারটি নতুন এলাকায়।
সেদিন সন্ধায় ঢাংমারী খালের পাশ দিয়ে সূর্য ডুবছি সুন্দরবনে।
শান্ত পশুর নদ, বনের দুই পাশ ধরে হরিণের ছোটাছুটি। গহিন বন থেকে অচেনা পাখি আর প্রাণীর হাঁকডাক আসছে। প্রকৃতির এক অপরূপ মায়া এসে পড়ছে যেন হৃদয়ে। হঠাৎ প্রকৃতির ছন্দ ভেঙে হঠাৎ কানে বাজল বিকট হর্নের শব্দ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে এগিয়ে আসছে জাহাজ। এরপর সারি ধরে জাহাজের দল যেন বনের ভেতর হানা দিতে শুরু করল। হরিণের দল ছুটে পালাল। ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর পাখির কলতানও থেমে গেল।
সুন্দরবনের বাসিন্দাদের এই বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বন বিভাগের অনুমতি ছাড়াই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তারা যে ‘নৌপথ’ চালু করেছিল, তা আরও বিস্তৃত ও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে আজ। প্রতিদিন তেল ও যাত্রীবাহী এক শ থেকে দেড় শ জাহাজ চলাচল করছে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন, এমনকি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও বিআইডব্লিউটিএ এ নৌপথ বন্ধ করেনি।
নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মণিরগোল। যার দুই পাশ হরিণ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র।
এ পথেই রয়েছে দুধমুখী, রায়েন্দা ও সন্ন্যাসী এলাকা, যা গাঙ্গেয়, ইরাবতীসহ চার ধরনের ডলফিনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র। সরকার এই স্থানকে চলতি বছর ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বন আইন ও বণ্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, বনের এই সংবেদনশীল অংশে বণ্য প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক সব ধরনের তৎপরতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ এই আইন লঙ্ঘন করছে। তারা নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করছে বনের এ অংশকে।
ঢাংমারী বন ফাঁড়ির এক জন বনপ্রহরী জানান, চাঁদপাই থেকে ঢাংমারী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় আগে হরহামেশা হরিণ, বানর, শূকর, পাখি এবং মাঝেমধ্যে বাঘ চলাচল করত। নৌপথ চালু হওয়ার পর এদের এখন আর দেখা যায় না। শব্দ আর ধোঁয়ায় এরা সবাই এখন বনের অন্যত্র চলে গেছে।
গত ১৭ নভেম্বর চাঁদপাই বন ফাঁড়ির কাছে গিয়ে দেখা মেলে, একটি বিশাল আকৃতির গমবাহী জাহাজ বনের মধ্যে নোঙর করেছে। ওই এলাকায় এখন নিয়মিতভাবেই বিশাল আকৃতির জাহাজ নোঙর করে বলে জানান বনপ্রহরীরা। প্রতিদিন মংলা বন্দর থেকে শতাধিক ছোট জাহাজ সুন্দরবনের ভেতরে পণ্য খালাস করে আবারও বন্দরে ফিরছে।
সম্প্রতিক সময়ে ঢাংমারী, চাঁদপাই, নন্দবালা ও জয়মণি এলাকা পরিদর্শনকালে হর্ন বাজিয়ে, দূষিত ধোঁয়া উড়িয়ে ও বর্জ্য তেল ফেলে জাহাজ চলতে দেখা গেছে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘নৌপথটি বন্ধ করতে আমরা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, নৌপথটি বন্ধ হয়নি। এতে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’
ইতি পূর্বে নৌসচিব ও বন বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞসহ একটি দল নৌপথ এলাকা পরিদর্শন করেন। বিশেষজ্ঞ কমিটি থেকে বলা হয়েছিল, নৌপথটি দিয়ে ভারী নৌযান যেভাবে চলছে, তাতে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে পারে। বিকল্প উপায় হিসেবে ঘসিয়াখালী খাল খনন করে তার মাটি কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। আর খনন শুরু হওয়ার আগের সময়টাতে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কম শব্দ করে আস্তে জাহাজ চলাচল করতে হবে। সেই পরামর্শ দেওয়ারও এক বছর হতে চলেছে। মন্ত্রণালয় আজও তা বাস্তবায়ন শুরুই করেনি।
গত বছরের অক্টোবরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে সুন্দরবনের অপেক্ষাকৃত কম বণ্য প্রাণীসমৃদ্ধ এলাকা রায়েন্দা-শাপলা-হরিণটানা-চাঁদপাই হয়ে নৌযান চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তারা সেই পরামর্শও শোনেনি। জাহাজগুলো ভেতরের সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মণিরগোল হয়েই চলাচল করছে। মন্ত্রণালয় থেকে তখন বলা হয়েছিল, আপাতত তিন মাস এই নৌপথ চলবে। আর এই সময়ের মধ্যে নিয়মিত নৌপথ খসিয়াখালী খাল খনন করতে হবে এবং মার্চের মধ্যে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকারক নৌপথটি বন্ধ হবে।
গত বছরের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বন বিভাগ জানিয়েছিল, তেল ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গোগুলো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় হাইড্রোলিক হর্ন বাজাচ্ছে। এতে হরিণসহ দুর্লভ প্রাণীরা দিগিবদিক ছোটাছুটি করছে এবং তাদের স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ ও জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটছে। এ ছাড়া কার্গোগুলো সুন্দরবনের ছোট খাল ও নদীতে চলাচল করায় উঁচু ঢেউ তৈরি করচ্ছে য়া বনের খাল ও নদীর দুই পাড়ে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। শরণখোলা ও বগী বন ফাঁড়ির বেশির ভাগ স্থাপনা দ্রুত নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয় ওই চিঠিতে।