আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাগেরহাটের নয় উপজেলায় আবারও দলীয় মনোনয়ন চান আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যানরা। যাদের অনেকেই আছেন এখন সময়ের অপেক্ষায়। আবার মনোনয়ন বঞ্চিত হলে অনেকের মানসিক প্রস্তুতি স্বতন্ত্র নির্বাচন করার।
তবে গত ৫ বছরে বিভিন্ন জেলার ৪টি সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিদের সাথে বরাদ্দ, বন্টনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে অধিক অংশ উপজেলার চেয়ারম্যানদের।
এদিকে দলীয় বিভিন্ন সূত্র মনে, উপজেলায় প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতামতের তুলনায় স্থানীয় এমপিদের প্রভাব ও সিদ্ধান্ত বেশী ভূমিকা রাখছে। এ অবস্থায় বিগত সময়ে দলীয় এমপিদের সাথে তাল মেলাতে না পারায় অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন বলে আশংকা করা হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন কর্তিক ঘোষিত তফশীল অনুযাই প্রথম দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত না বাগেরহাটের কোন উপজেলা। তবে দ্বিতীয় দফার তফশীল অনুযায়ী জেলার কচুয়া ও ফকিরহাট উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারী ।
এদিকে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত সোমবার বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. মোজাম্মেল হোসেন এমপি’র সভাপতিত্বে তার বাসভবনে বাগেরহাট সদর উপজেলার প্রার্থী মনোনয়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র মতে, ঐ সভা থেকে সিদ্ধান্ত হয় প্রার্থী মনোনয়নের পরিবর্তে জেলার চারটি সংসদীয় আসনের এমপিদের উপর আলোচনার মাধ্যমে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিগত পাঁচ বছরে বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান মুজিবর রহমানের সাথে স্থানীয় এমপি মীর শওকাত আলীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিলো প্রকাশ্য। খান মুজিবর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এমপির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য সমালোচনা এমনকি কটুক্তিও করেছেন। এই অবস্থায় সদর উপজেলার প্রার্থী মনোনয়ন বিষয়ে সোমবারের এই সিদ্ধান্তে খান মুজিবর রহমান মনোনয়ন লাভে কোনঠাসা থাকবেন।
এদিকে, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক ও বাগেরহাট-২ (বাগেরহাট সদর-কচুয়া) আসনের এমপি মীর শওকাত আলীর ব্যক্তিগত সহকারী মো: ফিরোজুল ইসলাম এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিনও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।
দলীয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘নিজের লোক’ ফিরোজুল ইসলামের প্রতি এমপি’র বিশেষ সহানুভূতি থাকবে বলে তাদের ধারণা।
বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান মুজিবর রহমান বলেন, এক মেয়াদ চেয়ারম্যান থাকার পর আবার প্রার্থী হতে তৃণমূল ভোট বা তদবিরের প্রয়োজন নেই। দলীয় মনোনয়ন দলের তরফ থেকে আসলে ভালো হয়।
এলাকাবাসী ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাহফিজুর রহমানের সাথে স্থানীয় এমপি মীর শওকাত আলীর দ্বন্দ্ব বিরোধ এতটাই প্রকট যে, গত পাঁচ বছরে এই দুই জনপ্রতিনিধি একসাথে স্থানীয় কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি।
মাহফুজকে হটাতে এমপি নিজ ক্ষমতায় ২০১১ সালে মাহফুজকে বাদ দিয়ে কেন্দ্র থেকে কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি অনুমোদন করিয়ে আনেন। জেলা আওয়ামী লীগ এখনও ঐ কমিটি অনুমোদন না করলেও এই দুই নেতাকে ঘিরে কচুয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা দুটি প্রকাশ্য ধারায় বিভক্ত। মাহফুজুর রহমানের পাশাপাশি মীর শওকাত আলী বাদশার ছোট ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ফজলে সাঈদ ডাবলু এই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।
এদিকে গত সোমবার শরণখোলা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইফুল ইসলাম খোকনের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় মৌখিক সিদ্ধান্তে স্থানীয় এমপির লোক হিসেবে পরিচিত উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান মিলনকে চেয়ারম্যান পদের জন্য মনোনিত করা হয়।
এখানকার বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দিন আকন। তিনি বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের এমপি ডা. মোজাম্মেল হোসেনের বিরোধীতাকারী অংশের নেতা। ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ডা. মোজাম্মেল হোসেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তার দলীয় সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে।
কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আকন দলীয় মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
কামাল উদ্দিন আকন দাবি করেন যে, তাকে বাইরে রেখে ডা. মোজাম্মেল হোসেনের নির্দেশে আওয়ামী লীগের যে তৃণমূল সভা করা হয়েছে তা অ-গঠণতান্ত্রিক ও অবৈধ।
ফকিরহাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার নিয়ামত হোসেন দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
২০১০ সালে জেলা মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির এক সভায় অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি স্থানীয় বাগেরহাট-১ (ফকিরহাট-মোল্লাহাট-চিতলমারী) আসনের এমপি শেখ হেলাল উদ্দিনের বিরাগভাজন হন। দলীয় পদ ছেড়ে নির্বাচিত অনেক চেয়ারম্যান পরে স্বপদে দায়িত্ব পালন করলেও সরদার নিয়ামত হোসেন আর স্বপদে ফিরতে পারেননি। ২০১৩ সালের ১৮ মে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান খান জাহিদ হাসান নিহত হন।
এই মামলায় এজাহারনামীয় আসামী হলে সরদার নিয়ামতের দলীয় সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। বৃহস্পতিবার ফকিরহাটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
সরদার নিয়ামত হোসেন আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাকে সভার নোটিশ দেয়া হয়নি। তবে আমি ঐ সভাস্থলে যাবো। আমার সদস্যপদ স্থগিত, আমি বহিস্কৃত না। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। মনোনয়নপত্রও কিনেছি। দেখা যাক কি হয়।’
মংলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী ইজারদার বলেন, ‘স্থানীয় এমপি তালুকদার আব্দুল খালেকের সাথে আমার ব্যক্তিগত বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু প্রার্থী মনোনয়নে তিনি নিশ্চয়ই ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে থাকবেন।’
এ সব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুজ্জামান বলেন, প্রার্থী নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপিদের মত থাকতেই পারে। তবে সব কিছুই আমরা সাংগঠনিকভাবে করার চেষ্টা করছি।
কচুয়া ও শরণখোলাসহ কয়েকটি উপজেলায় কিছু সমস্যা আছে। আমরা স্থানীয় কমিটি ও তৃণমূল কর্মীদের মতামত নিয়েই মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে চাই।