বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধ ভাবে অনুপ্রবেশ করে প্রতিনিয়ত মৎস সম্পদ লুটে নিচ্ছে ভিনদেশী জেলেরা। বিশেষ করে উত্তর বঙ্গোপসাগরের গভীর এলাকায় ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচরণ চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সুন্দরবন উপকুলে এবং গভীর সমুদ্রে মৎস আহরনে নিয়জিত জেলেরা জানান, ভারতীয় জেলেদের উৎপাতে তারা চাহিদামতো মাছ শিকার করতে পারছেন না।
চলতি (শীত) মৌসুমে ভারতীয় জেলেদের কারণে এখানকার জেলেদের মাছ শিকার ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের দায়ে গত ডিসেম্বের শেষ সপ্তহে দু’দফার ৫টি ফিসিং ট্রলারসহ ৭৩ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করে নৌ-বাহিনীর সদস্যরা।
সরেজমিন বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় সুন্দরবনের দুবলা, মেহেরআলী, আলোরকোল জেলেপল্লী ঘুরে জানা গেছে, প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশি জেলেরা বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া এলাকায় ট্রলার ও নৌকায় করে মাছ ধরেন। সাগর শান্ত থাকায় এ সময় জেলেরা বেশি মাছ পায়।
আবার এই মৌসুমেই বিদেশি বিভিন্ন ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ে মাছ শিকার করে। পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ড থেকে জেলেরা অবৈধভাবে বড় বড় অত্যাধুনিক ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢোকে। অধিকাংশ সময়েই তারা গোপনে মাছ শিকার করে চলে যায়।
বিদেশি জেলেরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে ট্রলারে বসে নৌবাহিনীর তৎপরতায় চোখ রাখে। নৌবাহিনীকে আসতে দেখলেই দ্রত পালিয়ে যায় তারা।
সুন্দরবন উপকূলের জেলেপল্লী দুবলারচরের মেহের আলীর টেকের জেলেদের মহাজন চট্টগ্রামের শুক্কুর ও মংলার মহাজন বুলবুল ইজারদার জানান, ভারতীয়রা বাংলাদেশি জেলেদের বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে মাছ ধরতে বাধা দেয়। কখনও কখনও ভারতীয়রা বাংলাদেশি জেলেদের ট্রলার ও নৌকায় হামলা চালায়, জেলেদের মারধর করে এবং লুটপাট চালায়।
মাছধরা ট্রলার এফবি মানিকের সারেং রায়মোহন মাঝি জানান, বিভিন্ন সময় ভারতীয় জেলেদের পাশাপাশি সে দেশে দস্যুদের হামলার স্বিকার হতে হয় তাদের।
দুবলারচর সংলগ্ন শ্যালারচর জেলে পল্লির জেলে, ইয়াছিন ও বাবুল আলম বলেন, চলতি বছরে সাগর উপকূলে যে মাছ ধরা পড়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। গভীর সমুদ্রে মাছ থাকলেও ভারতীয় জেলেদের উৎপাতের কারণে তাদের শিকার ব্যাহত হচ্ছে।
দুবলারচর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে দেশের উপকূলীয় জেলেরা বঙ্গোপসাগরের ৮ ও ১০নং বয়ায় জাল পেতে মাছ শিকার করে। সাগরের এ স্থানে জাল পাতা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও মাছ বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু ভারত ও থাইল্যান্ডের জেলেরা নৌ সীমানা লংগন করে প্রায়ই এ এলাকার জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
শরনখোলা জাতীয় মৎসজীবি সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন জানান, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে ভারতের কাকদ্বীপ এলাকা কাছে হওয়ায় সেখানকার বিপুলসংখ্যক জেলে এ দেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসে। মাছ ধরার অত্যাধুনিক জালসহ আধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকায় তারা অনেক বেশি মাছ আহরণ করতে পারে।
বাংলাদেশের জলসীমায় যে এলাকায় মাছের পরিমাণ বেশি, সাধারণত সেই এলাকায় তারা মাছ শিকার করে। তাদের দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশি জেলেরা ওইসব এলাকায় মাছ শিকার করতে পারেন না।
বাগেরহাটের মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের জেলে আ: হালিম হাওলাদার জানান, ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ ৫ ধরণের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করে। পাশাপাশি মাছের পোনাও ধরে। তাদের কাছে রয়েছে জিপিএস (বিশেষ সংকেত) নামক বিশেষ ধরণের যন্ত্র। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় জেলেরা যে পথ দিয়ে সাগরে আসে, আবার সে পথ দিয়েই ফিরে যায়।
জেলেরা জানান, বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় ফিসিং ট্রলার দেশীয় সমুদ্রসীমার প্রায় দেড়শ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করে মাছ ধরছে। বাংলাদেশের জেলেরা সেখানে গেলে তারা হামলা চালাচ্ছে।
দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব:) জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, “প্রায় সময়ই ভারত, থাইল্যান্ডও মিয়ানমারের জেলেরা দেশীয় জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে আমাদের হাজার কোটি টাকার মৎস সম্পদ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সাগরে মৎস সম্পদ কমে যাচ্ছে।
এসব জেলেপল্লির জেলে এবং শুটকি উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্তরা বিভিন্ন সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের জন্য আটক হলেও কয়েক দিনের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যাওয়ায় তাদের ক্ষোভ জানান। এসময় তারা সমুদ্র পাহারা বাড়িয়ে মৎস সম্পদ রক্ষার দাবি জানান।