প্রত্নতত্ব আর পূরাকীর্তির এক সমৃদ্ধ রাজধানি বাগেরহাট। বিশ্ব মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে আছে এ জেলায় অবস্থিত ইসলাম প্রচারক উলুঘ খানজাহান (রঃ)এর নির্র্মিত পূরাকীর্তি গুলো। যদিও অনেকে শুধুই ষাটগুম্বজ আর মাজারকেই মনে করে বাগেরহাটের ঐতিহ্য।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাল ও সেন আমলের পর মধ্যযূগে বর্তমান বাগেরহাটে গড়ে উঠেছিল একটি সমৃদ্ধ নগর। ‘খলিফা-ই-আবাদ’ বা ’খলিফাতাবাদ’ নামে এ শহরের প্রষ্ঠিতা ছিলেন ‘উলুঘ খান আল আজম হযরত খানজাহান (রঃ)’ [খানজাহান আলী নামে বেশি পরিচিত]।
এখনও অক্ষত অবস্থায় ১৪-১৫টি টিকে থাকলেও কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে ঐতিহাসিক এ নগরির বহু পূরাকীর্তি। এগুলো ছাড়াও আরো প্রায় শতাধিক মসজিদ ও খানজাহানীয় স্থাপত্যের ধ্বংস অবশেষ পাওয়া গেলেও সে সব রয়ে গেছে আমাদের লোক চক্ষুর আড়ালেই।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষণে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় থাকা জেলার ১৪/১৫টি পূরাকীর্তি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষণে থাকলেও আমরা অনেকেই ষাটগুম্বজ মসজিদকে বিশ্বঐতিহ্য প্রত্নসম্পদ হিসাবেই জানি।
বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় থাকা জেলার ১৪/১৫টি পূরাকীর্তি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষণে থাকলেও আমরা অনেকেই ষাটগুম্বজ মসজিদকে বাগেরহাটের এক মাত্র বিশ্বঐতিহ্য প্রত্নসম্পদ হিসাবেই জানি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নথিভূক্ত সংরক্ষণের তালিকায় থাকা বাকি পূরাকীর্তি গুলো হল- ১. হযরত খানজাহান (রঃ)এর মাজার (সমাধি), ২. মাজার সংলগ্ন পীরালি মোঃ তাহেরের মাজার ও সংলগ্ন এক গুম্বজ মসজিদ, ৩. নয় গুম্বজ মসজিদ, ৪. হযরত জিন্দাপীরের মাজার ও মসজিদ, ৫. রেজা খোদা মসজিদ (ছয় গুম্বজ বিশিষ্ট ধ্বংসপ্রাপ্ত), ৬. সিঙ্গাইর এক গুম্বজ মসজিদ, ৭. বিবি বেগনী এক গুম্বজ মসজিদ, ৮. চুনাখোলা এক গুম্বজ মসজিদ, ৯. হযরত খানজাহানের ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতবাড়ি, ১০. রনবিজয়পুর এক গুম্বজ মসজিদ, ১১. সাবেক ডাঙা পূরাকীর্তি বা খানজাহানের হোজরা খানা (প্রার্থনা কক্ষ), ১২. ছিলিয়াখানা বা অস্ত্রাগার, ১৩. ৩৫ গুম্বজ বিশিষ্ট বড় আযম খাঁ ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ ও ১৪. খানজাহান আমলের সড়ক।
খানজাহান ও তার কীর্তি নিয়ে কাজ কারা খানজাহান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারী সংস্থা সম্প্রতি তাদরে এক প্রতিবেদনে এসব প্রত্নসম্পদের মধ্যে ৬টি পূরাকীর্তিকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
ঐতিহাসিকগন মনে করেন, বাগেরহাটে খানজাহানীয় কীর্তিগুলো তুঘলক স্থাপত্যের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। এখনও অক্ষত থাকা সমাজ সংস্কারক খানজাহান (র) এর স্থাপত্যের সবগুলোতে বিভিন্ন লতা-পাতা ও ফুলের অলংকরণ চোখে পড়েও কালের আবর্তে অনেক প্রত্নসম্পদ পরিনত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। আর সেসব ধ্বংসস্তুপের মাঝে এখনও দেখতে পাওয়া যায় এসব টেরাকোটা। যথাযথ সংরক্ষনের অভাবে যা নষ্ট হচ্ছে দিন দিন।
বর্তমানে লবনাক্ততার জন্য বাগেরহাটে অধিকাংশ পূরাকীর্তি সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে এসব কীর্তি সংস্কারের সময় নিম্নমানের সাধারণ ইট দিয়ে সংস্কারের ফলে তা আরো দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাগেরহাট ইনফোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঐ সময়ের তৈরী যেসব স্থাপত্য রয়েছে তার তুলনায় সম্প্রতি যে সব পূরাকীর্তি সংস্কার করা হয়েছে তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং হারিয়ে যাচ্ছে খানজাহানীয় প্রত্ন বৈশিষ্ট।
পন্ডিতদের মতে, সুন্দরবন বনাঞ্চলের বিস্তৃতি ছিল পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পর্যন্ত। হযরত খানজাহান(র:) তার খলিফা-ই-আবাদ নগরীতে অসংখ্য দীঘি ও পুকুর খননের মাধ্যমে একদিকে সুপেয় পানির ব্যবহার অন্যদিকে বসবাসের জন্য যায়গা উঁচু এবং পাকা সড়ক তৈরী করে এক পূর্ণাঙ্গ নগরী গড়ে তুলেছিলেন।
এ নগরীর আসপাশসহ তৎকালীন খলিফা-ই-আবাদ রাজ্যে খানজাহানের(র:) পূরাকীর্তিগুলো বেশির ভাগই খাল-বিল, মাছের ঘের, ডোবা, পুকুর, নদী, ধানক্ষেত, জলাশয়, বাগান ও প্লাবিত স্থানে বিদ্যমান।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হযরত খানজাহানের (র:) অক্ষত পূরাকীর্তির চেয়ে যেসব কীর্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তার অধিকাংশই নিচু এলাকায় রয়েছে। পুকুর খনন ও চিংড়ী ঘের কাটতে গিয়ে কোথাও মসজিদের ফ্লোর ও দেওয়াল বেরিয়ে পড়েছে। কোথাও বা দেখা গেছে দিঘি ও পুকুরের সিড়ি অথবা মানুষের কবর, হাড়গোড় ও তৈজষপত্র।
ঐতিহাসিক লেনপুল এর মতে, ষাটগুম্বজ মসজিদটি সর্বপ্রথম ১৮৭১ খৃ: আগাছার তলদেশ হতে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করা হয়। পর্যায়ক্রমে আরো বেশকিছু কীর্তি উদঘাটিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের উদ্দ্যেগে ১৯২৮ খৃ:পর থেকে এসব পুরাকীর্তি সমূহ খুবই জরাজীর্ণ অবস্থায় থেকে সংস্কার ও সংরক্ষন শুরু করা হয়।
সর্বশেষ বিশ্বঐতিহ্য প্রত্নসম্পদগুলো ২০০১ খৃ: সংস্কারের কাজ করা হয়। ষাটগুম্বজসহ কয়েকটি কীর্তি এসময় সংস্কার করতে যেয়ে ব্যাপকভাবে প্রত্নবৈশিষ্ট নষ্ট করার অভিযোগে রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে একটি তদন্ত কমিটি ও গঠন করা হয়। সম্প্রতিকালে এসব পূরাকীর্তি সংস্কার করা হলেও চুনাখোলা এক গুম্বজের গায়ে সংস্কারের কোন ছোয়া লাগেনি আজও।
নেই মসজিদটি দেখতে যাওয়ার জন্য কোন রাস্তাও।
৮-৯ বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে একটি রাস্তা তৈরীর অনুমোদন লাভ করলেও অদ্যাবধি তা সম্ভব হয়নি। বিশ্বঐতিহ্য এ কীর্তির গা ঘেষে ৩ দিকে তৈরী করা হয়েছে চিংড়ী ঘের আর একদিকে করা হয় ধান চাষ। বৃষ্টি হলেই পানি উঠে ডুবে যায় এ মসজিদের মধ্যে।
প্রায় ৬’শত বছর আগের এসব কীর্তির অস্তিত্ব রক্ষায় প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণে পাশাপাশি এখন দরকার এসব স্থাপনার গুরুত্ব সম্পার্কে স্থানীয় জনগোষ্ঠির মঝে ব্যাপক স্বচেতনতা সৃষ্টি। আর তা না হলে আগামী প্রজন্ম বঞ্চিত হবে আমাদের সমৃদ্ধশালী অতীত ঐতিহ্য আর গর্বের এসব স্থাপনা থেকে।
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
রিপোর্টটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন খানজাহান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আরিফুল ইসলাম।