আজ থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে শুরু হচ্ছে ৩ দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব (রাসমেলা)। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও এ উৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বন বিভাগসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
কার্তিক মাসের শেষে বা অগ্রহায়ণের প্রথম দিকের ভরা পূর্ণিমার তিথিতে এ রাস উৎসব উদযাপিত হয়। হিন্দু ধর্মালম্বীরা এ সময় পূর্ণিমার জোয়ারের লোনা পানিতে স্নান করে তাদের পাপ মোচন হবে এমন বিশ্বাস নিয়ে রাস উৎসবে যোগ দিলেও, কালের বিবর্তনে এখন তা নানা ধর্ম-বর্ণের লোকেদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। আবাল-বৃদ্ধ বণিতা নির্বিচারে সবার পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে এ মেলা; পরিণত হয় এক মিলন মেলায়।
ইতোমধ্যে দেশের প্রত্যান্ত এলাকা থেকে উৎসবে যোগ দিতে লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকা যোগে তীর্থ যাত্রী ও দর্শনার্থীরা এসে দুবলার চরে সমবেত হয়েছে । সেই সাথে এসেছেন অসংখ্য বিদেশি পর্যটকও। উৎসব উপলক্ষে কুটির শিল্পের বিভিন্ন মালের পসরা সাজিয়ে বসেছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে।
জানা যায়, দুবলার চরের রাসমেলার আয়োজন হয়ে আসছে ২০০ শ’ বছর ধরে, যদিও এর সঠিক ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। ব্রিটিশ আমলে মেলার আয়োজন হতো পশুর নদীর পূর্ব দিকে প্রবাহিত শাখা পশুরের আগা নদীর সাগরসঙ্গমের পশ্চিম তীরে, দুবলা দ্বীপের পূর্ব পাড়ে। পরবর্তী সময়ে দুবলার পশ্চিম প্রান্তে বিশাল চর জেগে উঠলে মেলা স্থানান্তর করে আলোর কোল চরে আনা হয়। এ মেলার মূল পুণ্যার্থী ছিল প্রথমত সুন্দরবন তীরবর্তী শ্যামনগর, কয়রা দাকোপ, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, বরগুনা এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
আসতে আসতে এখবর বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পাকিস্তান আমল থেকে দেশ-বিদেশের অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকজনও মেলার আনন্দ উপভোগ করতে দুবলার মেলায় অংশগ্রহণ শুরু করেন।
সুন্দরবনের অন্যতম ব্যবসায়ী দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে দুবলার রাসমেলা প্রতিবছর এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান উৎসবে পরিণত হয়। মেলার মূল উৎসব তিন দিনের। রাসপূর্ণিমার ব্রাহ্মমুহূর্তের জোয়ারে স্নান ও অর্ঘ্য অর্পণ শেষ হলেই পুণ্যার্থীরা নৌকা ঘুরিয়ে বাড়িমুখো হয়। মেলা উপলক্ষে বন বিভাগ কিছু লোককে এখানে আসার আগাম অনুমতি দিয়ে থাকেন। এরা মেলাস্থলে এসে মণ্ডপ তৈরিসহ দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন, বন পরিষ্কার ও দোকানপাট বসানো এবং সাজানোর কাজ করে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও আমীর হোসেন চৌধুরী জানান, শুক্রবার ১৫ নভেম্বর থেকে সুন্দরবনের দুবলারচরে ঐতিহ্যবাহী রাস পূর্ণিমা শুরু হচ্ছে। ১৭ নভেম্বর শেষ হবে।
এ বছর হরিণ শিকার বন্ধে মেলা উদযাপন প্রস্তুতি কমিটির সভায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
মেলা উদযাপন কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক এ কর্মকর্তা আরো জানান, মেলায় যাওয়ার জন্য সুন্দবনের ভেতর দিয়ে ৮টি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। আগ্রহী দর্শনার্থীরা তিন দিনের প্যাকেজে মাথা পিছু বন বিভাগকে ৫০ টাকা রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষে তাদের (দর্শনার্থীদের) নিজেদের ব্যবস্থাপনায় মেলাস্থলে যেতে পারবেন। দর্শনার্থীদের যাতায়াত পথে নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক কোস্টগার্ড, পুলিশ, নেভী ও র্যাবের টহল ব্যবস্থা থাকছে।
হরিণ শিকার রোধ ও মেলায় আগন্তুকদের নিরাপত্তায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয় ১৬টি টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিম হরিণ আধিক্য এলাকায় কঠোর নজরদারিতে থাকবে। মেলা দর্শনার্থীদের কাউকেই রাতের বেলা বনের ভেতর দিয়ে চলাচল করতে দেয়া হবে না।
উৎসব আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান মেজর (অব:) জিয়া উদ্দিন জানান, প্রায় শত বছর ধরে বঙ্গোপসাগর কূলে সুন্দরবনের দুবলার চরে আলোর কোল নামক স্থানে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
তবে, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে মেলায় আগমন ইচ্ছুকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। ফলে এ বছর মেলার কলেবর কমে গিয়ে বিগত বছর গুলোর তুলনায় দর্শনার্থীদের সংখ্যা অনেক হ্রাস পেতেছে।
১৫ নভেম্বর ২০১৩ :: বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।