পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের কোন রকম তোয়াক্কা নাকে করে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক অবৈধ ইটের ভাটা। এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে হাজার হাজার মন বিভিন্ন প্রজাতির বনজ ও দেশিয় কাঠ। আর ফলে ঘটেছে ভয়াবহ বায়ু দূষন। দেখা দিয়েছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা।
অভিযোগ রয়েছে, এই অবৈধ এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কাজের অলিখিত বৈধতা দিয়েছেন নাকি শরণখোলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কেএম মামুন উজ্জামান। এজন্য প্রতি ২৫ হাজার ইটের বিপরীতে তাকে দিতে হবে এক হাজার ইট। সম্প্রতি তিনি উপজেলার সকল অবৈধ ভাটা মালিকদের নাম, ঠিকানা, বাবার নাম এবং মোবাইল নম্বর সম্বলিত একটি তালিকা তৈরী করে প্রত্যেককে তার কার্যালয়ে তলব করেন। একপর্যায়ে ইউএনও এলাকার উন্নয়ন কাজের নাম করে তাদের কাছ থেকে উল্লেখিত ইট দেয়ার স্বীকারোক্তি আদায় করেন। ইট না দিলে ভাটা মালিকদেরকে জেলজরিমানার ভয় দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
এদিকে, ইউএনওর অভিনব কায়দায় ইট চাঁদাবাজি এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই অবৈধ ইট পোড়ানোর অনুমোতি দেয়ায় এলাকার পরিবেশ সচেতন মানুষের মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জানায়। তারা বলছেন, ইটভাটার নির্গত ধোঁয়ায় বায়ু দূষিত হওয়ায় বায়ু বাহিত নানা রোগব্যধি দেখা দেবে। ভাটার আশপাশের গাছ-পালা মরে যাওয়াসহ ফসলের ওপরও পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এমনকি আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি ও অন্যান্য ফলফলাদির ফলনও হ্রাস পাবে। তাছাড়া উন্নয়নের নামে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কোনো কাজের বৈধতা দেয়া তার উচিৎ হয়নি বলে তারা মনে করেন।
ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রন অধ্যাদেশ ১৯৮৯ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রকার ইটভাটা বা পাজা স্থাপন করা যাবেনা। এর বাইরে করতে হলে আইনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে করতে হবে। যেমন, ভাটায় ১২০ ফুট উচ্চতার চঙ ব্যবহার, জনবহুল এলাকায় ও ফসলি জমিতে ভাটা নির্মান না করা এবং ইট পোড়ানোর কাজে দেশিয় বা বনজ কোনো প্রকারের কাঠ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ এসবের তোয়াক্কা না করে শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী, রায়েন্দা ও ধানসাগর ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন সোনাতলা, চালিতাবুনিয়া, বান্দাঘাটা, রাজাপুর, রতিয়া রাজাপুর, দক্ষিণ রাজাপুর, উত্তর রাজাপুর এলাকা এবং খোন্তাকাটা ইউনিয়নসহ এ চারটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে একশ্রেণির লোক অবৈধভাবে ইট পোড়াচ্ছেন। অন্যন্য বছর এরা অত্যান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে ইট পোড়ালেও এবার তারা ইউএনও কেএম মামুন উজ্জামানের অনুমোতি ও উৎসাহ পেয়ে প্রকাশ্যে এ অবৈধ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।
এসুযোগে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার চোরাকারবারীরা বন থেকে চোরাইভাবে সুন্দরীসহ অন্যান্য কাঠ কেটে এসব ভাটায় চড়া দামে বিক্রি করছে। এছাড়া দেশিয় কাঠেরও একটু বেশি মূল্য দেয়ায় দরিদ্র লোকেরা ছোট বড় নির্বিচারে গাছ বিক্রি করছেন। ফলে উজাড় হচ্ছে বনজ ও স্থানীয় গাছপালা। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কারো কারো পাজায় ইতিমধ্যে ইট পোড়ানো শেষ হয়েছে। কেউ কেউ পোড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আবার অনেকে ইট কাটা সম্পন্ন করে পোড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছেন। এসব ভাটার আশপাশে স্তুপ করা রয়েছে দেশিয় ভিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার মন কাঠ। এসব পাজার সবগুলোই স্থাপন করা হয়েছে বসতি এলাকা ও ফসলি জমিতে।
নাম প্রকাশ না করার সর্তে কয়েকজন পাজা মালিকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে জানা যায়, ইট পোড়ানোর জন্য ইউএনও তাদেরকে অনুমোতি দিয়েছেন। এক একটি পাজায় একবারে ২৫ হাজার ইট পোড়ানো হয়। প্রতি ২৫ হাজারে জ্বালানি হিসেবে কাঠ লাগে ৪০০ থেকে ৫০০ মন। তারা জানান, বর্তমানে কাঠের দাম ও শ্রমিকের মজুরী অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। তাই এক পিচ ইট কাটাতে প্রায় ছয় থেকে সাত টাকা খরচ পড়ে। তার ওপর ইউএনওকে দিতে হবে প্রতি ২৫ হাজারে এক হাজার ইট। ইট পরিবহনের খরচও দিতে হবে ভাটা মালিকদের। তা-না হলে ইট পোড়ানো যাবেনা। তার আদেশ অমান্য করলে আইনের আওতায় এনে জেলজরিমানা করা হবে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য এবং সাউথখালী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন খলিফা বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন আমার এ ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি অবৈধ ইটের পাজা রয়েছে। এতে দেশিয় কাঠের পাশাপাশি সুন্দরবনের কাঠ পোড়ানোর হচ্ছে। শুনেছি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এদেরকে পারমিশন দিয়েছেন। তিনি প্রশাসনের একজন কর্তাব্যক্তি হয়ে কিভাবে অবৈধ কাজের পারমিশন দিলেন তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি পরিবেশকে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে চাইছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বিনয়কৃষ্ণ বিশ্বাস জানান, ইট পোড়ানো নির্গত ধোঁয়া মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে ফুঁসফুঁস সংক্রমিত হয়ে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার পরিচালক ড. তরুনকান্তি সিকদার বলেন, ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর কোনো বৈধতা নেই। যতি কেউ তা করে থাকে সেটা সম্পূর্ণ বেআইনী। ইউএনও কেনো কেউই এ কাজের পারমিশন দিতে পারেননা। এদের বিরুদ্ধে শিগগরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) কে এম মামুন উজ্জামান বলেন, ইট পোড়াতে আমি কাউকে অনুমতি দিইনি। আমি পাজা মালিকদের ডেকে এনে জবাব দিহিতার মধ্যে এনেছি। তবে প্রতি ২৫ হাজার ইটের বিপরিতে এক হাজার ইট চাওয়ার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
তথ্য: মিজানুর রাকিব।।