বিশ্বের সর্ববৃহদ ম্যানগ্রোভ বা নোনা পানির বন সুন্দরবন। দেশের দক্ষিন-পশ্চিম উপকুলের এ বন বিখ্যাত নানা কারনে।
অপার প্রাকৃতিক সৈন্দর্য্য ন্যায় এ বনের অন্যতম আকর্ষণ বিশ্ব বিক্ষাত বয়েল বেঙ্গল টাইগা (সুন্দরবনের বাঘ)। নানা কারনে এতদিন এই বাঘকে বলা হত সুন্দরবনের রক্ষা কবজ। কারন বাঘ ছিল এ বনের মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম।
কিন্তু বর্তমানে সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে বাঘ আতঙ্কের চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম সুন্দরবনের বিভিন্ন জলদস্য ও বনদস্যু বাহিনী। সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলে ও বনজীবিদের দাবি বনে এখন বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর এক একটি জলদস্যু বাহিনী।
সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠা জলদস্যদের হামলা, লুটপাট, অপহরণে অতিষ্ঠ এখন দক্ষিন-পশ্চিশ উপকুলিয় জনপদ গুলোর কয়েক লাখ জেলে ও সাধারণ মানুষ।
শুধু লুটপাট, অপহরণ বা হামলা নয় মুক্তিপনের দাবিতে হাত-পা বেঁধে জেলেদের সাগরে নিক্ষেপ করার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
গত বছরের (২০১২ সালের) শেষের দিকে কুতুবদিয়া উপকূলের অদূরে একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ১২ জেলেকে সাগরে ফেলে দেয় জলদস্যুরা। পরে অন্য একটি ট্রলার উদ্ধার করে তাদের ক’য়েক জনকে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দু’দফায় মুক্তিপণের দাবিতে ট্রলার, জালসহ প্রায় ৮০ জেলেকে অপহরণ করেছে জলদস্যুরা।
বরগুনার মহিপুর, শরণখোলা ও বাগেরহাট মৎস্যজীবী সংগঠন সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার ভোরে বঙ্গোপসাগরের ১নং বয়ার এলাকায় ও শুক্রবার সুন্দবনের দুবলার চর সংলগ্ন নারকেলবাড়িয়া এলাকায় জলদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনীর সদস্যরা জেলে বহরে হামলা চালিয়ে ৫০ ও ৩০ জেলেকে অপহরণ করেছে।
অনুসন্ধানে জান যায়, বর্তমানে সুন্দরবনের চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা এই ৪টি রেঞ্জেকে ঘিরে সক্রিয় রয়েছে কমপক্ষে ১৫টি জলদস্যু বাহিনী।
বাহিনীগুলো হলো- শহিদুল বাহিনী, আমজাদ বাহিনী, জাকির বাহিনী, ফরহাদ বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, রুবেল বাহিনী, মুর্তজা বাহিনী, বাকিবিল্লাহ বাহিনী, আনোয়ার বাহিনী, মাহবুব বাহিনী, তছলিম বাহিনী, জুলফিকার আলী গামা বাহিনী, নাসির বাহিনী, জিহাদ বাহিনী ও রেজাউল ওরফে শীর্ষ বাহিনী।
এছাড়া আরও কয়েকটি বাহিনী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য নিয়ে ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
গত দু-তিন বছরে র্যাব ও কোস্টগার্ডের সাথে বন্দুকযুদ্ধে এসব বাহিনীর অন্তত ৯টির প্রধানরা মারা গেলেও পরে ওই সব গ্রুপের (বাহিনীর) নিয়ন্ত্রণ নেয় তাদের সহযোগীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সক্রিয় বাহিনীগুলোর মধ্যে ৬টি বাহিনী বেশি শক্তিশালী। এদের চাঁদা না দিয়ে সুন্দরবনে যেতে পারেন না জেলেরা।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, এ বাহিনী গুলোর মধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জ এর উত্তর দিক নিয়ন্ত্রণ করে আমজাদ বাহিনী আর দক্ষিণ দিক নিয়ন্ত্রণ করছে জাকির বাহিনী। খুলনা রেঞ্জ এর উত্তর ও দক্ষিণ পাশের নিয়ন্ত্রণ মাহবুব বাহিনী ও জাহাঙ্গীর বাহিনীর। চাঁদপাই নিয়ন্ত্রণ করে মুর্তজা বাহিনী। আর শরণখোলা রেঞ্জ অঞ্চলের আধিপত্ত রেজাউল ওরফে শীর্ষ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সুন্দরবন এলাকায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী জাহাঙ্গীর বাহিনী। তার বাহিনীতে রয়েছে অর্ধশতাধিক সদস্য ও দেশি-বিদেশি বিপুল পরিমান অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।
জাহাঙ্গীর বাহিনীর সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখা যায় খুলনা অঞ্চলে। বাহিনীর প্রধান ছিল রাজু। যে কিনা বর্তমানে ভারতে পলাতক রয়েছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা জানায়, জলদস্যুদের রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নৌযান ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক।
আর এসব কারনেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন এলাকাকেন্দ্রিক এই জলদস্যুদের চাঁদা দিয়েই মাছ ধরতে যেতে হয় জেলেদের। একটি গ্রুপকে চাঁদা দিয়ে সাগরে যাওয়ার পর অন্য গ্রুপ এসে আবার চাঁদা দাবি করে। আর জেলেরা এতে অপারগ হলে অপহরণ করে জলদস্যুরা। পরে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয় তাদের।
এক হিসাবে দেখা যায়, গত ৩ বছরে জলদস্যুদের হাতে নিহত হয়েছে ২০০ এর বেশি জেলে। আর এসব বাহিনী হাতে প্রতিবছর গড়ে অপহৃত হয় ৮০০ থেকে এক হাজার জেলে। অপহৃতদের বেশির ভাগই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মুক্তি পান। আর এসব জলদস্যুকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, মদদদাতাদের অনেক সময় শনাক্ত করা গেলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমানের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। তবে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার মুক্তিপণের দাবিতে দু’দফায় প্রায় ৮০ জেলে অপহরণের ব্যাপারে কোষ্টগার্ড মংলা সদর দপ্তরের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মহিউদ্দিন জানান, অপহৃত জেলেদের উদ্ধারে গত শুক্রবার থেকে মংলা, শরণখোলা ও সাতক্ষীরা এলাকায় কোষ্টগার্ডের ৩টি টিম পৃথকভাবে অভিযান শুরু করেছে।
ইতোমধ্যে গতকাল (শনিবার) দুপুরে অপহৃত জেলেদের মধ্য মারেলগঞ্জ, রামপাল ও মংলা এলাকার ৪ জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
জিম্মি সব জেলেরা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
এদিকে, উপকুলীয় মৎস্যজীবি সমিতির নেতারা জানান, ফিশিং ট্রলারে অব্যহত ডাকাতি, অপহরণ ও মাছ লুটের ঘটনায় জেলেরা এখন সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এ অবস্তা চলতে থাকলে মহাজন-জেলে উভয়ই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তাই অবিলম্বে দস্যুদমনে র্যাবের-কোষ্টগার্ডকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর কঠোর অভিযান দরকার বলে দাবি করেন মৎস্যজীবি অনেক নেতা।