চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের পর এবার সুন্দরবনের কাছে বরগুনার পাথরঘাটায় দ্বিতীয় জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা এবার হবে জাহাজ শিল্প।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে জাহাজভাঙা শিল্প চিহ্নিত ‘মারাত্মক দূষণকারী’ হিসেবে।
জানা গেছে, জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপনের জন্য স্থান হিসেবে পাথরঘাটা উপজেলার গাববাড়িয়া চরকে নির্বাচন করা হয়েছে। জায়গাটি সুন্দরবনের পাশে ও বন প্রভাবিত এলাকা।
বন আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন অনুযায়ী, সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোনো শিল্পকারখানা, ভারী ইমারত ও স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ।
সুন্দরবনের এক পাশে বাগেরহাটের রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে পরিবেশবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। এ ছাড়া সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে একটি অবৈধ নৌ-রুট চালু হওয়ায় বনের ক্ষতি হচ্ছে বলে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে। কিন্তু ওই রুটটি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বনের আরেক পাশে জাহাজভাঙা শিল্প গড়ে তোলা হলে নানামুখী দূষণের কবলে পড়বে সুন্দরবন।
৫২ দশমিক ২৪ একর জমির ওপর প্রস্তাবিত এই জাহাজভাঙা ইয়ার্ড স্থাপনের জায়গাটি থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ছয় কিলোমিটার। এর দক্ষিণে টেংরা, চরলাঠিমারা ও হরিণঘাটা নামে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর আয়তনের তিনটি সংরক্ষিত বন রয়েছে। উত্তর দিকে রয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর আয়তনের বন বিভাগের সৃজিত শ্বাসমূলীয় বন। এই তিনটি বনে রয়েছে অসংখ্য শ্বাসমূলীয় বৃক্ষ এবং হরিণ, শূকর, মেছো বাঘ, গুইসাপসহ অসংখ্য বন্য প্রাণী।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পাথরঘাটায় এই শিল্প স্থাপনের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। একে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আগ্রহ ও সম্মতি জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারদলীয় সাংসদ গোলাম সবুর।
এর আগে আশির দশক থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপিত হওয়ায় সেখানকার কয়েক কিলোমিটার এলাকার প্রায় পাঁচ লাখ উপকূলীয় গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশীয় গবেষকেরা দেখিয়েছেন, জাহাজভাঙা শিল্পের কারণে সীতাকুণ্ড উপকূলের মাটি, পানি, মাছ ও সর্বোপরি জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সীতাকুণ্ডে এ পর্যন্ত ১৮০টি জাহাজভাঙার ঘাট স্থাপিত হয়েছে। এদের মধ্যে বর্তমানে চালু ৭৭টি আছে।
তবে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া দাবী করেণবলেশ্বর নদের তীরে জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপিত হলে তাতে সুন্দরবনের জন্য কোনো ক্ষতি হবে না। তিনি বলেন, চলতি বছরের মধ্যে ওই ইয়ার্ডের সমীক্ষার কাজ শেষ করে আগামী বছরের মধ্যে ভৌত অবকাঠামোগত কাজ শুরু করা যাবে। শিল্প মন্ত্রণালয় জাহাজভাঙা ইয়ার্ড স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের মতামত জানতে চাইলে দুই দপ্তরই আপত্তি জানায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, ‘পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব বিবেচনায় প্রতিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ তথা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) বলেশ্বর নদের তীরকে জাহাজভাঙা শিল্পের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্বাচন করা সমীচীন হবে না।’ অধিদপ্তরের চিঠিতে বলা হয়, ২০১০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর জাতীয় জীববৈচিত্র্য মূল্যায়ন ও কর্মপরিকল্পনা-২০২০ তৈরি করেছে।
এতে মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে বলেশ্বর নদের মোহনাকে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব বিবেচনা করে এখানে জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপন না করার পক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তর।
বন বিভাগের আপত্তিপত্রে বলা হয়, পাথরঘাটা ও এর পার্শ্ববর্তী সুন্দরবনে প্রায় ৬০ প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচিত এলাকায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে সুন্দরবনের অবস্থান। জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপিত হলে ব্যাপক হারে পানি, বায়ু ও শব্দদূষণের কবলে পড়বে সাগর ও সুন্দরবন। এরপর বলেশ্বরতীরের ‘পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা শিল্প’ স্থাপন করা হবে—এমন তথ্য জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এর জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অনুরোধ করা হয়। একে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ বিবেচনায় অনুমতি দেওয়ার জন্যও বলা হয় চিঠিতে। পরিবেশ অধিদপ্তর এখনো ছাড়পত্র দেয়নি।
জাতিসংঘের নৌযানসংক্রান্ত চুক্তি ‘ভেসেল কনভেনশন’ অনুযায়ী, কোনো দেশ পুরোনো জাহাজ আমদানি করতে চাইলে অবশ্যই রপ্তানিকারক দেশ থেকে তা বর্জ্যমুক্ত করে আনতে হবে। দেশের উচ্চ আদালতও এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ পুরোনো জাহাজ আমদানিকারকেরা তা মানছে না।
তারা বিষাক্ত বর্জ্যমুক্ত না করেই জাহাজ এনে এখানে ভাঙছেন এবং বর্জ্যগুলো সীতাকুণ্ড উপকূল ও বঙ্গোপসাগরে ফেলছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ ইউনিয়নভুক্ত দেশের সমুদ্রসীমা থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদের বেশির ভাগই তেলবাহী ট্যাঙ্কার ও রাসায়সিক পদার্থ পরিবহনকারী।
ইউরোপীয় কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব জাহাজের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ।
জাহাজভাঙা শিল্প পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম-এর বাংলাদেশ শাখার সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আলী জানান, সীতাকুণ্ডে অবস্থিত জাহাজভাঙার ঘাটগুলোকে এখনো সরকার পরিবেশবান্ধব করতে পারেনি। তারা নিয়মিতভাবে উপকূলীয় এলাকা ও বঙ্গোপসাগর দূষণ করে যাচ্ছে। এখন সুন্দরবনের পাশে যদি এ শিল্প স্থাপিত হয়, তাহলে সুন্দরবন দূষণের হুমকিতে পড়বে।
দ্বিতীয় জাহাজভাঙা শিল্প এলাকা: ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালের দপদপিয়া সেতুর (আবদুর রব সেরনিয়াবাত) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাথরঘাটায় দেশের দ্বিতীয় জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপনের ঘোষণা দেন। ওই বছরের ২১ আগস্ট এই শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব পাঠায় বরগুনা জেলা প্রশাসন। প্রস্তাব পেয়ে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করে শিল্প মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ৮ অক্টোবর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয়। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং সেখানে জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চল স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানান।
এবিষয়ে বরগুনা-২ (পাথরঘাটা-বামনা-বেতাগী) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ গোলাম সবুর বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চল করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এখানে চার কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন ও ১০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা শেষ হলেই অবকাঠামো নির্মাণের চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে।
সুন্দরবন ও আশপাশের পরিবেশের হুমকি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, এখানে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, এটা সম্পূর্ণ পরিবেশসম্মতভাবে করা হবে।
এবিষয়ে পটুয়াখালী-বরগুনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মিহির কুমার দো বলেন, ‘জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপনের জন্য বন অধিদপ্তর থেকে আমাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছিল। এলাকাটি পরিবেশ সংকটপূর্ণ হওয়ায় আমরা আপত্তি জানিয়ে লিখিত মতামত পাঠিয়েছি। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।’
এদিকে সদ্য গঠিত সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন বলেন, সরকার সুন্দরবনের এক পাশে বাগেরহাটের রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এবার আরেক দিকে জাহাজভাঙা শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাংলাদেশের রক্ষাপ্রাচীর এই বনটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।
সুত্র: প্রথম আলো।।
ইফতেখার মাহমুদ ও এম জসিমউদ্দিন।