রামসার সচিবালয়ের চিঠি এবং সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরের রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ে আপত্তির নথি, জলাভূমি সংরক্ষণ বিষয়ক রামসার কনভেনশনের সচিবালয় থেকে গত ২২ জুন ২০১১ তারিখে বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়।
চিঠিতে রামসার সচিবালয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ে জানতে চায়:
১) রামসার সাইট সুন্দরবনের পাশে পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে। এ বিষয়ে রামসার সচিবালয় সংবাত পত্রে প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১-২ কিমি দূরে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন সহ অত্যাধিক ধূলা নির্গত হবে। ফলে ক্রমান্বয়ে ঐ এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণী তথা জীব-বৈচিত্রের উপর বিরুপ প্রভাবের আশংকা রয়েছে। তাই রামসার সচিবালয় সুন্দরবনের উপর সম্ভাব্য প্রভাবের জন্য ইআই এ সম্পর্কে জানতে চায়।
২) সুন্দরবনের আক্রাম পয়েন্টে কয়লা লোড আনলোডের পরিকল্পনা সম্পর্কে। রামসার কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে ফুলবাড়ী প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা রপ্তানির জন্য আক্রাম পয়েন্টে কয়লা উঠা নামা করা এবং জাহাজ চলাচলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ও ভৌত অবকাঠামা নির্মাণের ফলে সুন্দরবনের উপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চায়।
৩) সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমার মধ্যে একটি শীপ ইয়ার্ড ও সাইলো নির্মাণের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে । রামসারের চিঠি পাওয়ার পর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে মতামতের জন্য বন অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য বিভাগের কাছে চিঠি প্রদান করা হয়। এর মধ্যে খাদ্য বিভাগ ও শিল্প মন্ত্রণালয় কোন মতামত প্রদান থেকে বিরত থাকে। বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়, মূল প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে গোজামিল দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, সরকার পরিবেশ সমীক্ষার অনুমোদন ছাড়াই যে প্রকল্প এগিয়ে নিতে মরিয়া। প্রকল্প বিষয়ে সরকারেরই অন্যান্য দপ্তর যেমন: বন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি প্রকাশ করা হয়।
বন অধিদপ্তরের আপত্তি:
প্রধান সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দীন আহমদ গত ২৯ সেপ্টম্বর ২০১১ তারিখে পরিবেশ ও বনমন্ত্রালয় বরাবর চিঠি দিয়ে জানায়: “Sundarbans Ramsar Site সুন্দরবনের অংশ যার Legal Custodian বন অধিদপ্তর। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং Landscape Zone এ এমন কোন শিল্প কারখানা স্থাপনা করা যুক্তিযুক্ত হবে না যা সুন্দরবন তথা Sundarbans Ramsar Site এর জীববৈচিত্রের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলবে। কয়লা ভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের Royal Bengal Tiger তথা সমগ্র সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকির সম্মুখীন হবে।
বাংলাদেশ Ramsar Conservation এর Signatory থাকায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষার বাধ্যবাধকতা আন্তর্জাতিক ভাবেওআরও বেশি দ্বায়িত্বশীল করে। বন সংরক্ষক, খুলন অঞ্চল সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় কয়লা ভত্তিক Power Plant স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। Sundarbans Ramsar Site(World Heritage Site ) বিধায় কয়লা ভিত্তিক Power Plant প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি জীববৈচিত্র সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে পুন:বিবেচনা করার জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হলো। “এর চেয়ে স্পষ্ট ভাবে সরকারের একটা অধিদপ্তরের পক্ষে রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধীতা করা সম্ভব নয়। জানতে আগ্রহ হচ্ছে, সরকারের বন্ধুপ্রতীম ভারতীয় সাম্রজ্যবাদের স্বার্থে এভাবে বাগড়া দেয়ার পায়তারা করায় প্রধান বন সংরক্ষককের কি গতি হয়েছে!
পরিবেশ অধিদপ্তরের মতামত:
পরিবেশ অধিদপ্তর তার ২১ জুলাই ২০১১ এর চিঠিতে প্রথমে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বলে উল্ল্যেখ করলেও যেহেতু এর সাথে পরিবেশের বিষয়যুক্ত আছে সেজন্য মতামত প্রকাশ করে বলে: “পরিবেশ অধিদপ্তর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সুন্দরবনের জৈববৈচিত্র বিশেষত সুন্দরবন রামসার সাইটের গুরুত্বপূর্ণ জৈববৈচিত্রের উপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। পরিবেশ অধিদপ্তর এই প্রকল্পের ব্যাপারে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিলেও সেই ছাড়পত্র পরিবেশ বিষয়ক কতগুলো শর্তের অধীন। বিস্তারিত পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সুন্দরবনের উপর কি প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে কোন মতামত ব্যাক্ত করতে পারে না।
তাই পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিস্তারিত পরিবেশ সমীক্ষা রিপোর্ট আহবান করছে। ইআইএ রিপোর্ট থেকে যদি দেখা যায়, এই প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের জৈববৈচিত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এবং এর নিরাময়ের জন্য প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো ক্ষতিদূর করার জন্য যথেষ্ট নয়, তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তর অবস্থানগত ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নেবে এবং প্রকল্পের পক্ষে কোন পরিবেশ ছাড়পত্র ইস্যু করবে না।
উল্ল্যেখ্য, পরিবেশ অধিদপ্তর এই চিঠি দেয়ার পর বহুদিন পার হয়েছে, ইতিমধ্যে ইআইএ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের দ্বারা গণশুনানিতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, সরকার অবস্থনগত ছাড়পত্রে দেয়া শর্ত ভঙ্গ করে ইআইএ অনুমোদনের আগেই জলাভূমি ভরাট করছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অবস্থানগত ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নি, ইআইএ’র ব্যাপারেও আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয় নি। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তর এখনও পর্যন্ত রামপাল প্রকল্পের পক্ষে পরিবেশ ছাড়পত্রও প্রদান করে নি।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আপত্তি:
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তোলা আপত্তির উদাহরণ:
১) আকরাম পয়েন্টে কয়লা লোড আনলোড কেন্দ্র নির্মাণ প্রসঙ্গে :
ক) এর ফলে শব্দ দূষণ ঘটবে এবং সুন্দরবনের শান্ত পরিবেশের এবং এর জৈববৈচিত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
খ) নির্মাণ কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট যানবাহন বন এবং নদী পথে চলাচলের ফলে পরিবেশ দূষণ ঘটতে পারে।
২) সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা পরিবহন বিষয়ে :
ক) সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নদী পথে বাড়তি জাহাজ চলাচল সুন্দরবনের শান্ত পরিবেশে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।
খ) জাহাজ থেকে তেল চুইয়ে, তেল লিকেজ হয়ে বনের নদী দূষণ করতে পারে।
গ) জাহাজ থেকে নির্গত ময়লা আবর্জনা ও সুয়ারেজের মাধ্যমে সংলগ্ন এলাকার গাছপালা ও প্রাণীর উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। যার ফলে সুন্দরবনের জৈব ভারসাম্য নষ্ট হবে।
ঘ) ইঞ্জিন থেকে নির্গত নাইট্রোজেন্ ও সালফারের বিভন্ন অক্সাইড গ্যাস সুন্দরবনের বায়ু দূষণ করবে।
দেখা যাচ্ছে, শুধু রামপালের জনগণ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞই নয়, খোদ সরকারেরই বিভিন্ন দপ্তর থেকে সুন্দরবনের পাশে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি উঠেছে।
লেখক- কল্লোল মুস্তফা।।