মৌসুমের শুরুতেই বাগেরহাটে বাগদা চিংড়ির রেণুর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চাষীরা উচ্চমূল্য দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী রেণু কিনতে পারছেন না।
ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের পূর্বাপর সময়ে জেলেরা সাগরে মা-চিংড়ি (মাদার শ্রিম্প) ধরতে না পারা এবং বর্তমানে ভালো মানের মা-চিংড়ি ধরা না পড়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। দ্রুত সমস্যার সমাধান না হলে বাগদা উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে বলে আস্বাংকা সংশ্লিষ্টদের।
হ্যাচারি মালিকরা জানান, ভালো মানের মা-চিংড়ির বয়স হওয়া উচিত কমপক্ষে দেড় বছর। কিন্তু সাগরে এখন যে মা-চিংড়ি ধরা পড়ছে, সেগুলোর বয়স এক বছরের নিচে। এসব চিংড়ির ডিম কম এবং অপুষ্ট। ফলে রেণু উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সংকটের কারণে মা-চিংড়ির দামও বেড়ে গেছে। এখন প্রতিটি মা-চিংড়ি ১০ হাজার টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। তাই রেণুর দামও বেড়েছে দু-তিন গুণ।
চাষীরা জানান, রেণুসংকটের কারণে মৌসুমের শুরুতেই তারা উৎপাদন চক্র থেকে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার অন্তত তিনটি তিথি (গোন) হারিয়েছেন। বাগেরহাটে বাগদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
বাগেরহাটে চিংড়ির রেণু বিক্রির প্রধান কেন্দ্র রামপাল উপজেলার ফয়লাবাজারের ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান মনি বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর থেকে মা-চিংড়ি আহরণ করতে না পারায় গত ২ থেকে ২০ মে পর্যন্ত হ্যাচারিগুলো কোনো রেণু উৎপাদন করতে পারেনি। তিনি বলেন, রামপালের রেণুর পাইকারি বাজার ফয়লাবাজারে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি রেণুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বাজারে রেণু সরবরাহ নেই বললেই চলে। নদীতেও এবার রেণু কম। ফলে দ্বিগুণ দাম দিয়েও চাষীরা চাহিদা অনুযায়ী রেণু পাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে হ্যাচারিতে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ির রেণু (প্রতি হাজার) সাত থেকে আট শ টাকায় এবং নদীর পোনা এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১৫ দিন আগেও এই দাম ছিল যথাক্রমে ৩০০ থেকে ৩৫০ এবং ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বাঁশতলি গ্রামের চিংড়িঘের ব্যবসায়ী পাভেল রহমান বলেন, তার ১৫০ বিঘার ঘেরে এখনই ৫০ হাজার রেণু ছাড়া প্রয়োজন। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে স্থানীয় ফয়লাবাজারে দ্বিগুণ দাম দিয়েও তিনি ৫০ হাজার পোনা কিনতে পারেননি। এরই মধ্যে চিংড়ি উৎপাদনে অত্যাবশ্যক অমাবস্যা ও পূর্ণিমার তিনটি তিথি পেরিয়ে গেছে। এর প্রভাবে তার বার্ষিক উৎপাদন হ্রাস পাবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর মৎস্য আড়তদার রেণু ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, তিন সপ্তাহ ধরে বাগদা চিংড়ি রেণুর মারাত্মক সংকট চলছে। বেশি দাম দিয়েও হ্যাচারি বা নদীর রেণু পাওয়া যাচ্ছে না। কবে নাগাদ রেণু সরবরাহ স্বাভাবিক হবে তা বলতে পারছেন না হ্যাচারি মালিকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঘের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কক্সবাজারের অন্যতম বড় বাগদা রেণু উৎপাদনকারী রেডিয়েন্ট হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম চৌধুরী শনিবার বলেন, ‘সাগরে ভালো মানের মা-চিংড়ি মিলছে না। আমরা যে মা-চিংড়ি পাচ্ছি, তার শতকরা ১০ ভাগ থেকে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। ছোট ডিমে রেণু কম হচ্ছে। ফলে রেণুসংকট দেখা দিয়েছে। বেড়েছে মা-চিংড়ির দাম। এ অবস্থা আরো দুই মাস অব্যাহত থাকতে পারে।
তবে জেলা মৎস্য অফিস এই রেণু সংকটের পেছনে হ্যাচারীর উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবার পাশাপাশি আগাম বৃষ্টিকেও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, আগাম বৃষ্টির কারণে মৌসুমের আগেই চাষীদের ঘেরগুলো মাছ ছাড়তে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ায় রেণুর চাহিদা আকস্মিকভাবে বেড়েছে। কিন্তু হ্যাচারী মালিকরা এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে বাজারে সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, হ্যাচারীমালিকরা চাহিদা অনুযায়ী রেণু সরবরাহ করতে পারছেন না। আবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারা রেণুর দামও অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এ পরিস্থিতি সাময়িক। শিগগিরই সংকট কেটে যাবে। বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে না।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর জেলার নয়টি উপজেলায় ৩৯ হাজার ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন।
সূত্র: প্রথম আলো ও বনিক বার্তা ।।