সুন্দরবন। উর্বর মাটি আর নোনা পানির মহত্বে গড়া আমাদের প্রাকৃতিক রত্ন-ভাণ্ডার।
একদিকে অথৈ জলরাশি, অপরদিকে নির্মল সবুজের খেলা। সুন্দরবনের সৌন্দর্যের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।
১৯১১ সালে সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গ কিঃ মিঃ এবং বর্তমানে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিঃ মিঃ। তারমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৬০১৭ বর্গ কিঃ মিঃ এবং বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সুন্দরবনের অংশ বিশেষকে ১৯৯২ সালের ২১ শে মে ‘রামসার এলাকা’ (Ramsar Site) ঘোষনা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে UNESCO সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ (World Heritage Site) হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন আর মানুষের আগ্রাসনে সুন্দরবন এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। এই বিশাল বনভূমির প্রধান বৃক্ষ হলো সুন্দরী গাছ। এছাড়া রয়েছে গেওয়া, বাইন, কেওড়া, গরান, ধুন্দল, পশুর, গোলপাতাসহ অসংখ্য বৃক্ষরাজী। দেশের শতকরা ৬০ ভাগ কাঠ সংগ্রহ করা হয় সুন্দরবন থেকে। মধু এ বনের অন্যতম একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। ওষুধ তৈরীর ভেষজ সামগ্রী এ বন থেকে আহরণ করা হয়।
সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে অসংখ্য নদী ও খাল যার আয়তন প্রায় ১৮৭৪ বর্গ কিঃ মিঃ। দেশের মৎস সম্পদের ৫ শতাংশ যোগান দেয় সুন্দরবন সংলগ্ন নদী-নালা, খাল ও জলাশয়। উল্লেখযোগ্য মৎস সম্পদের মধ্যে রয়েছে চিংড়ি, ভেটকি, আইড়, ফ্যাসা, মেদ, ইলিশ, বাইন, পোয়া, ভোল, কাঁকড়া, পাঙ্গাস, রূপচাঁদা, প্রভৃতি। এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের বাগদা চিংড়ি পোনা আহরণ করা একটি অন্যতম পেশায় পরিণত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে চিংড়ি পোনা আহরণ করতে গিয়ে অন্য অন্য প্রজাতির কোটি কোটি পোনা মাছ ধ্বংস করা হচ্ছে।
সুন্দরবনে অসংখ্য প্রজাতির জলজ এবং স্থল প্রানী বসবাস করে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিরল প্রজাতির বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং চিত্রা হরিণ। বর্তমানে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৪ শত এবং হরিণ প্রায় ৩০ হাজার। চোরা শিকারীদের তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বন বিভাগ ও বাংলাদেশ বন্য প্রাণী ট্রাষ্টের (ডব্লিউটিবি) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার কমেছে ৬৯ শতাংশ। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাণী বাঘ সংরক্ষনে জরুরী উদ্যোগ না নিলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সুন্দরবন থেকে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে (সূত্রঃ প্রথম আলো ২৪ নভেম্বর, ২০১২)।
সুন্দরবনের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে বনরক্ষী। কিন্তু সুন্দরবন রক্ষার মূল দায়িত্ব পালন করে এ বনের বাঘ। তাই বাঘ রক্ষার জন্য আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণের ৫টি জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনার প্রায় ১৭টি উপজেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবন জীবিকার জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার অন্যতম কারন হচ্ছে সুন্দরবন সংলগ্ন জমিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ফসলাদি না হওয়া এবং নদী ভরাট হওয়া ইত্যাদি। যেমন রামপাল-মংলায় এখন ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টি ইউনিয়নে ধান চাষ তেমন হচ্ছে না। অথচ ২০০০ সালের আগে এখানে প্রতি বিঘা জমিতে ২০ থেকে ৩০ মন ধান উৎপাদন হত।
ঠিক একইভাবে নদী ভরাট হওয়ার কারণে এখানকার জেলে, মাঝিরা বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সুন্দরবনমুখী হচ্ছে। তারা সুন্দরবন থেকে মাছ, মাছের পোনা, মধু ও কাঠ সংগ্রহ করে জীবন চালাচ্ছে।
রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ
বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের কাছে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানী (এনটিপিসি) এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের জন্য রামপালের সাপমারী-কাটাখালী মৌজায় ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ কাজ প্রায় সম্পন্ন করেছে। যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯.৫০ কিঃ মিঃ থেকে ১০ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত। যদিও সরকার আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে কাগজে দূরত্ব দেখানো হচ্ছে ১৪ কিঃ মিঃ। পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় ৩০ আগষ্ট ১৯৯৯ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেষ্ট ও এর চতুর্দিকে ১০ কিঃ মিঃ এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষনা করেছে। তাছাড়া প্রধান বন সংরক্ষক স্বাক্ষরিত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে এক পত্রে উল্লেখ করেন, “Sundarbans Ramsar Site সুন্দরবন অংশ যার Legal Custodian বন অধিদপ্তর।
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং Landscape zone এ কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের Royal Bengal Tiger তথা জীব বৈচিত্র হুমকির সম্মুখীন হবে।” উল্লেখিত পত্র দ্বারা প্রধান বন সংরক্ষক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রামপালে স্থাপনের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার আহবান জানান। নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয় সরাসরি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে কোন মতামত না দিলেও সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লাবাহী জাহাজ চলাচল যে সুন্দরবনের ক্ষতি করবে সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করে।
সংরক্ষিত সুন্দরবনের অতি সন্নিকটে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিখিত পত্রের মাধ্যমে রামসার কর্তৃপক্ষ এবং ইউনেস্কো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে (পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয়, ২০১২)। এ উদ্বেগের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় কি ব্যাখ্যা প্রদান করেছে তা জানা যায়নি। প্রস্তাবিত প্রকল্প বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর এ মর্মে মতামত প্রদান করে যে, “A notable portion of Sundarbans falls under the Bagerhat district. Department of Environment is concerned about the possible adverse impact on the rich biodiversities of Sundarban Ramsar Site due to implementation of this said Project.”
এই কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার জন্য পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ৩টি মামলা করেছে যা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারী ২০১২ এক খোলা চিঠির মাধ্যমে দেশের ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান স্বাক্ষরিত আবেদনে সুন্দরবন রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে সুন্দরবনের অতি সন্নিকটে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবী জানান হয়। আবেদনকারীগণ হলেন – সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র; অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সভাপতি, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র; ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক, শাহ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; রাশেদা কে. চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গণস্বাক্ষরতা অভিযান; সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা; ডাঃ এম এ মতিন, মহাসচিব, বাপা; আবু নাসের, চেয়ারম্যান, পবা; সারা হোসেন, অবৈতনিক পরিচালক, ব্লাস্ট; খুশি কবির, সমন্বয়ক, নিজেরা করি; বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন; ফারহা কবির, নির্বাহী পরিচালক, এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এবং ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।
সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র এখনও নেয়নি। অথচ ৪ নভেম্বর ২০১২ অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ মালিকানায় প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে এবং রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ‘‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানী (প্রাইভেট) লিমিটেড” নির্মানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বলেন ‘‘এই অনুমোদন দুঃখজনক। এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে পরিবেশের ছাড়পত্রটি যেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষেই দেওয়া হয়। সরকার যদি আইন না মানে তাহলে আইন মানবে কে? রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে”।
এদিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কোথা থেকে কয়লা কেনা হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে অষ্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইন্ডিয়া ইত্যাদির কথা বলা হচ্ছে। সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী বলেছেন ‘‘রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বড় পুকুরিয়া থেকে কয়লা তোলা হবে।” এখন প্রশ্ন আসছে বড় পুকুরিয়া থেকে কয়লা তুলে আমরা কেন রামপাল নিব? কেন আমরা বড় পুকুরিয়াতে এ প্রকল্প করবো না? তাহলে তো ব্যয় সাশ্রয় হবে।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘‘পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে। এর অর্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর চাপ দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে ছাড়পত্র দিতে তাদের বাধ্য করা।”
এ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের করতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে জলাশয় ভরাট, কার্বন নির্গমন, বন ক্ষতিগ্রস্তকরণ, বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্তকরণসহ দেশি বিদেশি মোট পাঁচটি আইন বা কনভেনশন লঙ্ঘন করতে হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিচ্ছে। উন্নত বিশ্ব কার্বন নির্গমনের দায় হিসেবে বাংলাদেশকে অর্থ দিলেও এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকার নিজেই বিপুল পরিমাণ কার্বন নির্গমনের পথে এগুচ্ছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত জলবায়ু তহবিলের ওপর আঘাত বয়ে আনতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১১ সালের ২৩ মে রামপালের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অবস্থানগত ছাড়পত্র দেয়। এতে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্ণসম্মতি অর্থাৎ এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) না হওয়া পর্যন্ত কোনো যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাবে না। জলাভূমিও ভরাট করা যাবে না। এসব শর্ত ভাঙলে অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
অথচ অবশ্য বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। পিডিবির মাটি কাটার আটটি যন্ত্র দিয়ে সমানে সীমানা নির্ধারণের জন্য মাটি ভরাট চলছে। শ্রমিকদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পও বসানো হয়েছে। জোর করে ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত, অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিল করে অবিলম্বে পিডিবির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
ধ্বংস হবে সুন্দরবন
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে ধীরে ধীরে সুন্দরবন ও আশপাশের নদীগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সালের ৫ মে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জায়গা পরিদর্শন করে। তারা নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ২৩ ধরনের ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে।
তাদের মতে, সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে, তৈরি হবে অসংখ্য কয়লা ডিপো, শুরু হবে গাছ কাটা, বনে আগুন লাগানো এবং বাঘ, হরিণ ও কুমির ধরা। কয়লা পোড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের জীবমন্ডল ও বায়ুমন্ডলকে দূষিত করবে।
সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাস বনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে।
ওই গবেষণা শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্ক করে বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পুরো কার্যক্রম শিগগিরই বন্ধ করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সচল হলে হারিয়ে যাবে বিরল প্রজাতির গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন। এসব ডলফিন শুধু বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকার পশুর নদেই দেখা যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাগেরহাটের মংলা, চাঁদপাই ও শরণখোলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদ ও শ্যাওলা নদীকে গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিনের সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধির স্বার্থে গত ২৯ জানুয়ারী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষনা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের শিক্ষক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী ২০১১ সালের আগষ্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বাগেহাটের রামপাল ও মংলা উপজেলা এবং সংলগ্ন সুন্দরবন এলাকার ওপর গবেষণা শেষে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়, রামপালে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে ২০ বছরের মধ্যে এলাকার পানি, বাতাস ও মাটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এলাকার পানি শতভাগ, বাতাস ৯০ ভাগ এবং মাটি ৬৫ ভাগ দূষিত হয়ে পড়বে। তাপমাত্রা ও মাটিতে লবণাক্ততা বাড়বে। হারুন চৌধুরী জানান, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য, কয়লা ধোয়া পানি, কয়লার সালফার, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান এবং কেন্দ্র থেকে নিঃসরিত কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাসের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস থেকে এসব দূষণ সৃষ্টি হবে। ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ এলাকার কৃষি ও মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে, সবুজবেষ্টনী ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
পিডিবি সূত্র জানায়, প্রতি ঘন্টায় রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য ১৪৪ কিউসেক পানির প্রয়োজন হবে। এক হাজার ফুট গভীর থেকে এই বিপুল পরিমান পানি তুললে এ অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে লবণ পানি ঢুকবে, যা মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ডেকে আনতে পারে।
আমেরিকান বিশেজ্ঞ বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে নির্গত হবে ১ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায়, ২৬৪০০ টন সালফার ডাই-অক্সাইড, যা এসিড বৃষ্টি সৃষ্টি করে, ১৯০০ টন কার্বন মনো-অক্সাইড, যা মাথা ব্যথা ও হৃদরোগ সৃষ্টি করে।
তাছাড়া লক্ষ লক্ষ টন ছাই, তরল কয়লা বর্জ্য, গরম পানি, ধোঁয়া এবং অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ধ্বংস করবে পরিবেশ তথা মানুষ, ঘেরের মাছ, মংলা বন্দর ও সুন্দরবন সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। লবনাক্ততার কারনে উপকুলের মানুষ ধান, সুপারী, নারকেল সহ প্রায় সব ফসলাদি হারিয়েছে।
এখন তাপ বিদ্যুৎ এর জন্য হারাতে যাচ্ছে পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মৎস্য সম্পদসহ বাঁচার শেষ অবলম্বন সুন্দরবন।
সরকার দূষণ কমানোর জন্য যে ‘‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল মেথড” ব্যবহারের কথা বলছে তাতে পরিবেশের দূষণ খুব একটা বেশী কমবে না। ড. এস. সি. সিটাল, পরিচালক, এনটিপিসি’র তথ্য অনুসারে, ভারত আশা করছে ২০১৭ সালে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে, তাতে শতকরা ১২ ভাগ পরিবেশ দূষণ কম হবে।
অর্থাৎ শতকরা ৮৮ ভাগ দূষণ অব্যাহত থাকবে।
গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ আমাকে বলেছিল, ‘‘নাকের উপর দুই ইঞ্চি পানি আর একহাত পানি সমান কথা”!!! সুতরাং কোনটিই আমাদের সুন্দরবনকে রক্ষা করতে পারবে না।
ভারতের গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এনটিপিসির একই ধরনের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল হয়ে গেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধার মুখে। এনটিপিসি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে চেয়েছিল মধ্য প্রদেশের নরসিংহপুর জেলায়। প্রস্তাবিত ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে একটি সংরক্ষিত বন থাকায় দেশটির পরিবেশ অধিদপ্তর সেটি নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। তাহলে আমরা কেন সুন্দরবনের পাশে এ ধরনের একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প করব? আমাদের সুন্দরবন কি একটি গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি নয়?
গত ১২ এপ্রিল ২০১৩, শুক্রবার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্রের “পরিবেশগত প্রভাব নিরুপন” বিষয় জনমত পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে পিডিবি। বিকাল ৩.৩০ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ বিষয় বিশদ আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞগণ। এতে অংশ নেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, সেভ দি সুন্দরবন সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি বৃন্দ।
এখানে সরকারের প্রতিনিধি ছাড়া সবাই এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং ক্ষতিকর দিক গুলো তুলে ধরেন। পরিশেষে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী মহোদয় সবাইকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, আপনাদের সাথে আলোচনা না করে কিছু করা হবে না। কিন্তু বিগত ২০শে এপ্রিল সরকার ভারতের সাথে এবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংক্রান্ত ৩ টি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
পরিশেষে বলতে চাই, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু আমাদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে সরকার কেন রামসার, ইউনেস্কো, পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ কারও মতামতকে তোয়াক্কা না করে এবং দেশের পরিবেশ আইন লংঘন করে এ ধরনের একটি ক্ষতিকর/অলাভজনক প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য তাড়াহুড়ো করছে।
আশা করি সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং বন্ধ হবে সুন্দরবনের পাশে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন আমাদের মায়ের মত। সিডর, আইলার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজের জীবন দিয়ে আমাদের রক্ষা করে। তাই আসুন নিজেদের স্বার্থে আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করি।
-ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম, সুন্দরবন গবেষক
প্রধান সমম্বয়কারী, সেভ দি সুন্দরবন।।