প্রচ্ছদ / খবর / বছরের শেষ পূর্ণিমায় বসেছে ঐতিহ্যবাহী দরগার মেলা

বছরের শেষ পূর্ণিমায় বসেছে ঐতিহ্যবাহী দরগার মেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ইনফো ডটকম

মাজারের দীঘির পাড়ে জিকিরে মশগুল ভক্তবৃন্দ। ছবি: মো. শহিদুল ইসলাম।

প্রতি বছরের মতো চৈত্র মাসের পূর্ণিমার তিথিতে বাগেরহাটের হযরত খানজাহান (রহ.) এর মাজার প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে বাৎসরিক মেলা। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে চৈত্রের এই পূর্ণিমা হল বছরের শেষ পূর্ণিমা।

প্রায় ছয়শ বছর ধরে চৈত্র পূর্ণিমার তিথিতে মাজারে এই মেলার আয়োজন হয়ে আসছে বলে দাবি আয়োজকদের।

বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদসহ তৎকালীন প্রাচীন নগরী খলিফতাবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান। শাসক ও ধর্মপ্রচারক খানজাহান মাজারের এই বাৎসরিক মেলা স্থানীয়ভাবে ‘দরগার মেলা’ বা ‘দরগাহ মেলা’ নামে অধিক পরিচিত। তবে অনেকেই খাঞ্জেলী মেলা হিসেবেও অবিহিত করেন বছরের শেষ এই মেলাকে।

শুক্রবার শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এই মেলা শেষ হবে রোববার। তবে এরপর ‘ভাঙ্গা মেলা’ হিসেবে তা চলবে প্রায় পুরো সপ্তাহ ধরে। মেলা ঘিরে শুক্রবার সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্ত-আশেকান ও দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেন প্রায় সাড়ে ছয়শ বছরের পুরানো বাগেরহাটের ঐতিহাসিক এই মাজার প্রাঙ্গণে। দুপুরে গড়িয়ে বিকেল নামার আগেই দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড় দেখা গেছে মাজার ও এর আশপাশের এলাকায়।

মেলা ঘিরে সেখানে বিভিন্ন ধরণের পন্যের পশরা সাজিয়ে বসেছেন পাঁচ শতাধিক মৌসুমি ব্যবসায়ী। মেলায় আসা ভক্ত-দর্শনার্থীরা ধর্মীয় প্রার্থণার পাশাপাশি এ দোকান, ও দোকন ঘুরে নিজেদের পছন্দের পণ্য কেনাকাটা করছেন।

মেলায় আসা ভক্তরা বলছেন, খানজাহানের সঙ্গে মানুষের আত্মিক প্রেম ও ভালোবাসা আছে। যার জন্য প্রতিবছর তারা এখানে ছুটে আসেন। এখানে এক সঙ্গে সবাই নামাজ আদায় করেন, জিকির আজগার করেন।মেলা ঘিরে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সঙ্গে চোখে পড়ে, বিভিন্ন ধরনের দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে লালন, মুর্শিদী, ভাটিয়ালীসহ আধ্যাত্মিক গানের আসর।

অনেক ভক্ত ও দর্শনার্থীই দেখা যায় মাজার প্রাঙ্গণের বিশাল দীঘিতে গোছল করতে। রাতভরও লোকে-লোকারন্য থাকে পুরো মাজার প্রাঙ্গণ। অনেকেই আবার দলবদ্ধ হয়ে মশগুল হন জিকির আজগরে।

রোগ মুক্তি, দোয়া, সমস্যার সমাধানসহ নানা বিশ্বাস থেকেও বহু মানুষ আসেন এখানে। তারা মেতে থাকেন যে যার মত প্রার্থনায়।

মাজারের খাদেম ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফকির তারিকুল ইসলাম বলেন, চৌদ্দশ খ্রিস্টাব্দে হযরত খানজাহান আলী (রহ.) পূর্ণভূমি বাগেরহাটে আসেন। তাঁর মাজার এলাকায় শত শত বছর ধরে এই মেলা চলে আসছে। খানজাহানের জীবন দশায়ও বছরের এই সময় তাঁর কাছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্ত আশেকানরা আসতেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমার তিথিতে তারা এখানে এসে মাজার জিয়ারত ও দীঘিতে গোসল করেন। মনোবাসনা পূর্ণের জন্য আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করেন। নানা আয়োজনের সঙ্গে চলে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান।

মেলায় যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে জেলা পুলিশ, টুরিষ্ট পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালন করছেন।

মেলায় আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া এলাকায়। অনেক বছর এই মেলার কথা শুনেছি। তাই সবাই মিলে আসা। খুবই ভাল লাগে, এখানে যে দীঘি রয়েছে, সেখানে গোসল করে খুব ভালো লাগলো।

নুরুননাহার নামের এক নারী বলেন, শুক্রবার ভোরে আসছি। সোমবার যাব। এখানে মাজার ভাই-বোনদের সাথে গান করব, সবাই মিলে প্রার্থণা করব। আশাকরি মনের চাওয়া পূরণ হবে।

আয়োজকরা বলছেন, রোববার রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেলা শেষ হলেও, আরও কিছু দিন থাকতে দোকানপাট। ভাঙ্গা মেলা হিসাবে থাকবে মানুষের আনাগোনা। সব মিলিয়ে সপ্তাহ ধরে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা যেমন আসবেন এখানে, তেমনি ব্যবসায়ীরা তাদের পন্য বিক্রয় করবেন।

বাগেরহাটের প্রবীণ শিক্ষক প্রফেসর চৌধুরী আব্দুর রব বলেন, দরজার এই মেলা এ অঞ্চলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী মেলা। সব ধর্মের মানুষের আগমনে যুগযুগ ধরে সৌহার্দের পরিবেশে এখানে এই আয়োজন চলছে।

নানান পদের মিষ্টান্ন, দেশীয় খাবারের পাশাপাশি এই মেলা ঘিরে তাল পাখা, বিভিন্ন ধরনের পাতায় বোনা পাটি, মাটির তৈজসপত্র, কাঠ, বাঁশ ও বেতের সামগ্রীসহ দেশীয় নানান পণ্যের সম্ভার বসতো। আধুনিক নানা পণ্যের ভিড়ে এখনো এই ঐতিহ্য কিছু টিকে আছে। দরজার মেলার পরেই এখানকার দোকানিরা চলে যান এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত চৌত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায়। বাগেরহাট অঞ্চলের ঐতিহ্য ও অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রেই এই মেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এসআই/আইএইচ/বিআই/১২ এপ্রিল, ২০২৫

About বাগেরহাট ইনফো নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

 

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.