চাঁদপুরের মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করা সারবাহী এমভি আল-বাখেরা জাহাজে ৭ জনকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গেল রাতে বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। আকাশ জাহাজটির লশকর ছিলেন।
বিশেষ প্রতিনিধি, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
গেল এক বছর ধরে বাড়িতে আসতো না আকাশ মন্ডল, যোগাযোগও ছিলনা পরিবারের সঙ্গে। তবে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড যে সে ঘটাতে পারে তা কারো ভাবনায়ও আসেনা।
সোমবার বিকেলে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন কথাই জানা গেছে।
গেল মঙ্গলবার দিনগত গভীর রাতে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার বাকেরগঞ্জ এলাকা থেকে আকাশ মন্ডলকে জাহাজে ৭ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করে র্যাব।
মূলঘর গ্রামে মূলত আকাশ মন্ডলের নানা বাড়ি। নানা বাড়ি হলেও আকাশের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই গ্রামেই বলে জানান স্থানীয়রা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই গ্রামের সরকারি শিশু পরিবারের পার্শবর্তী খাস (সরকারি) জমিতে থাকতেন আকাশের নানা সন্তোষ মন্ডল। সেখানেই এখন আকাশের আরেক ভাই থাকেন।
প্রতিবেশিরা বলছেন, ছোট বেলা থেকেই অভাব আর নানা সংকটে বেড়ে ওঠে ওরা দুই ভাই। অভাবের কারণে ছোট-খাট চুরি করেছে বলে অভিযোগ আছে, তবে আকাশ যে কাউকে খুন করতে পারে এটা ধারণায় আসে না।
‘একাই ৭ জনকে হত্যা করে ফেলবে আকাশ! তাও যাদের সঙ্গে এক সাথে কাজ করে তাদেরই।’ এটা স্থানীয়দের কাছে এখনও রহস্যজনক বলে মনে হয়।
পরিবার ও স্থানীয়রা বলছেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে এলাকার বাইরে আকাশ মন্ডল। এরআগে দুই ভাই এক সঙ্গেই থাকতেন। তবে গেল এক বছর ধরে তাদের মাঝে কোন যোগাযোগ নেই।
আকাশের বড় ভাইয়ের নাম ছিল বিধান মন্ডল। বছর দেড়েক আগে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে তাঁর নাম মো. আবির হোসাইন।
বুধবার সন্ধ্যায় ওই বাড়িতে গিয়ে আবিরকে পাওয়া যায়নি। সেখানে টিনের বেড়া-চালের ছোট্ট ঘরে দেখা মেলে আবিরের স্ত্রী আঁখি বেগমের সঙ্গে। এক বছর আগে বাগেরহাট সদর উপজেলার আঁখির সঙ্গে বিয়ে হয় আবিরের। তিনি বলেন, বিয়ের পর একবারই আকাশ বাড়িতে এসেছিল। তাও এক বছর আগে। এরপর আর কখনও সে আসেনি। তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগও ছিলনা।
তাদের ঘরের উল্টো পাশেই বাড়ি সৈয়দ জিহাদুল ইসলামের। তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে এলাকায় দেখিনা। অভাব ও অভিভাবক না থাকায় এলাকায় মাছ-শাকের মত ছোট চুরিতে জড়িয়ে ছিল আকাশ। তবে সে এমন নৃশংস হতে পারে তা মনে হয়নি। শান্ত সভাবেরই ছিল এলাকাতে। মাছ ধরা, দিনজমুরি কাজ করতো। বছর চার আগে ফকিরহাটের ফলতিতা বাজার এলাকায় সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়ে ছিল দুই ভাই। তবে সেই দোকান বেশি দিন টেকেনি।
ওই গ্রামের মো. জুয়েল বলেন, নারী ঘটিত একটা বিষয় নিয়ে দুই বছর আগে এলাকা ছেড়ে যায় আকাশ। এরপর আর তাকে দেখিনি। শুনেছি মাঝে এক বার নাকি আসছিল। আজ অনলাইনে দেখলাম জাহাজে ৭ খুন করছে এই আকাশই।
গ্রামের বাসিন্দাদের ভাষ্য, এলাকায় থাকতে বিড়ি-সিগারেট খাওয়া ছাড়া কোন মাদক সেবনে জড়িত এমন কখনও শোনেননি কেউ। সরকারি যেই জমিতে তারা নানারা থাকতেন সেখানেই তাদের জন্ম। ছোট বেলায় বাবা জগদীশ মন্ডল মারা যাওয়া পর মা ইসলাম ধর্ম গ্রাহণ করেন। পরে তার অন্যত্র বিয়ে হয়। এরপর নানা-নানীর কাছে বড় হতে থাকনে তারা। নানা-নানীর মৃত্যুর পর ওই দুই সেখানে থাকতেন।
সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরেন আকাশের বড় ভাই আবির হোসাইন। তিনি বলেন, এক বছর হলো তার সাথে যোগাযোগ নেই। একটু মনকষাকষি হই ছিল আমার সাথে, তারপর আর কোনা যোগাযোগ নেই। এলাকা থেকে যাওয়ার পরই জাহাজে কাজ নেয়। তারপর একবারই বাড়িতে এসেছে। তাও গত বছরের শীতের সময়।
তিনি জানান, তার বাবার বাড়ি পার্শবর্তী মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া এলাকায়। ‘তবে সেখানে আমরা কখনও যাইনি। আমাদের জন্মমাটি এখানে।’
আকাশ বিয়ে করেছে কিনা সে বিষয়েও জানা নেই উল্লেখ করে আবির বলেন, ‘এলাকায় থাকতে তো বিয়ে করেনি। জাহাজে জাহাজে থাকতো এটাই জানতাম। আর আমাদের কারো সাথেই কোন কথা হতো না। টিভিতে দেখে লোকে বলছে, প্রথমে তো বিশ্বাস করিনি। পরে দেখি আকাশরেই দেখায়। সে যদি ওই ঘটনা ঘটায় তবে তাঁর শাস্তি হোক।’
ঘটনার পর তিনি বাড়িতে কোরও সাথেই যোগাযোগ করেননি বলে দাবি তার ভাইয়ের। এলাকায়ও কেউ তাদের এক বছরের মধ্যে দেখেনি বলে জানান।
র্যাবের ভাষ্য, জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় আকাশ মণ্ডল ‘একমাত্র’ খুনি। নিয়মিত বেতন–ভাতা ও ছুটি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি প্রথমে জাহাজের মাস্টারকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যা করেন। জাহাজের অন্য ব্যক্তিরা জীবিত থাকলে সহজে ধরা পড়ে যাবেন ভেবে বাকি সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন বেঁচে যান।
আকাশকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানতে চাইলে র্যাবের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর পালানোর সময় আকাশ নিহত ব্যক্তিদের পাঁচটি মুঠোফোন নিজের ব্যাগে করে নিয়ে যান। এর মধ্যে জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া ও গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে যাওয়া সুকানি জুয়েলের মুঠোফোনও ছিল।
ঘটনার পর ছায়াতদন্ত শুরু করে র্যাব। এরপর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তাঁর অবস্থান শনাক্ত করে অভিযান চালায়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রথমে পুরো ঘটনা অস্বীকার করেন আকাশ। দাবি করেন, তিনি জাহাজেই ছিলেন না। এরপর তল্লাশি করে যখন নিহত ব্যক্তিদের মুঠোফোন পাওয়া যায়, তখন তিনি পুরো ঘটনা বলতে শুরু করেন।
২৩ ডিসেম্বর দুপুরে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করা ‘এম ভি আল-বাখেরা’ নামের একটি সারবাহী নৌযান থেকে ৫ জনের রক্তাক্ত মরদেহসহ ৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুজনের মৃত্যু হয়।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সাতজন মানুষকে আকাশ একা খুন করেছে শুনে আমরাও অবাক হয়েছি। এরপর বিভিন্নভাবে অন্তত ১২ বার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রতিবারই একই রকম তথ্য দিয়েছে আকাশ। এ সময়ের মধ্যে তাঁর দেওয়া তথ্যের সবকিছুই ক্রস চেক করেছি। যেমন সে বলেছে, এই জায়গায় এই দোকান থেকে ঘুমের ওষুধ কিনেছি। আমরা সেখানে টিম পাঠিয়ে নিশ্চিত হয়েছি তাঁর তথ্য সঠিক। আবার সে বলেছে, বাজার করার কথা বলে ট্রলারে করে পালিয়েছে। আমরা আজ সকালে একই স্থানে তাঁর পালানোর সময় অনুযায়ী টিম পাঠিয়ে দেখেছি, সেখানে ওই সময় ট্রলার চলাচল করে। সব মিলিয়ে তাঁর সব তথ্য সঠিক পেয়েছি।’
র্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, গ্রেপ্তারের সময় আকাশের কাছ থেকে একটি গ্লাভস, একটি ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহত ব্যক্তিদের ব্যবহৃত পাঁচটি ও আকাশের ব্যবহৃত দুটিসহ মোট সাতটি মুঠোফোন এবং বিভিন্ন জায়গায় রক্তমাখা নীল রঙের একটি জিনস প্যান্ট উদ্ধার করা হয়। ঘটনার সময় ওই জিনস প্যান্ট পরে ছিলেন তিনি।
এসআই/আইএইচ/বিআই/২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪/