বিশেষ প্রতিনিধি, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
ব্যস্ত সড়কে হঠাৎ দাঁড়ালো তিন চাকার এক ইজিবাইক। ঝুঁকি নিয়ে ব্যাটারিচালিত সে যানের ডান পাশ দিয়ে দৌঁড়ে উঠলেন এক যাত্রী। আছে মূল সড়কের উপর পার্কি, বাস থমিয়ে যাত্রী ওঠানামা, চলে জেব্রাক্রসিং না মানাসহ সব অব্যবস্থাপনাই।
এ চিত্র বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কে। স্থানীয়রা বলছেন, সড়কের এই অব্যবস্থাপনা প্রায় নিয়মিত। যেখানে জরুরি সঠিক ব্যবস্থাপনা, তবে তা না করে সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ হাতে নিয়েছে এখানে একটি পদচারী পারাপার সেতু (ফুটওভার ব্রিজ) নির্মাণের কাজ।
এই সড়কের ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনেও হচ্ছে একই ধরণের একটি পদচারী সেতু। যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় ৩ কোটি টাকা। তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, সওজ’র ৬ কোটি টাকা ব্যায়ের এই প্রকল্প কোন কাজেই আসবে না, নেই প্রয়োজনীয়তাও।
সওজ বাগেরহাট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, যানজট নিরসন, দূর্ঘটনা প্রতিরোধ ও পদচারীদের নিরাপদে সড়ক পারাপারের জন্য রক্ষনাবেক্ষণ খাতের অর্থায়নে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কংক্রিট বেজ স্টিলের স্টাকচারের পদচারী সেতু দুটির উচ্চতা হবে ২০ফুট, আর দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট। সেতুর উভয় পাশে দুটি করে থাকবে মোট ৪টি সিড়ি।
গত ১৭ এপ্রিল এর নির্মাণ কাজের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ৩০ জুন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড কাজ পায়। যা নির্মাণ সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র দুই মাস।
কার্যাদেশ পেয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। বেশ কয়েকটি গাছ কেটে ইতমধ্যে বেজমেন্টের জন্য খোড়া হয়েছে বড় বড় গর্ত। আনা হয়েছে ইট, বালু, পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রী।
সূত্র বলছে, জুনের মাঝে অর্থ ব্যয় করতে তড়িঘড়ি করে নেওয়া হয়েছে এই প্রকল্প।
এদিকে জেলার অসংখ্য ভাঙাচোরা সড়ক, সেতু, রাস্তাঘাট ঠিক না করে এমন পদচারী সেতু নির্মাণকে বিলাসী পরিকল্পনা হিসেবেই দেখছেন সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিমাধ্যমে ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বিএমএ বাগেরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. মোশাররফ হোসেন লিখেছেন, ‘ঢাকা শহরে শত শত ফুটওভার ব্রিজ আছে, ব্যাস্ত রাস্তার উপরে ক’জন লোক পারাপার করে তা গবেষণার বিষয়। মোবাইল কোর্ট বসিয়েও ঢাকার ব্যাস্ত রাস্তায় মানুষকে ওভার ব্রীজে তোলা যায়না। সেখানে বাগেরহাট শহরে এই ফুট ওভার ব্রীজ কতজন পারাপার করবে সেটাই বিষয়। ….’
কাজি ইয়াসিন নামের এক ব্যক্ত এই বিষয়ে লিখেছেন, এসি রুম তৈরি করতে যেমন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। ঠিক তেমনি এসি রুমের মধ্যে বসে বিগ বাজেটের প্রকল্প হাতে নেওয়া খুবই সহজ। দুর্নীতি করতে হলে প্রকল্পের প্রয়োজন।…’
শহরের নতুন কোট এলাকার বাসিন্দা দিপক দাস বলেন, এগুলো করা হচ্ছে ভালো, তবে কেউ ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার কাজ। এ না করে এখানে পাশের পার্কিং এর জন্য জায়গা করার প্রয়োজন ছিল। দরকার ছিল এখানে ভালো ট্রাফি ব্যবস্থাপনার।
শহিদুল ইসলাম নামের এক তরুণ বলেন, দুর্নীতি করতে হলে প্রকল্পের প্রয়োজন, সেই প্রকল্প জনগণের জন্য কতটুক প্রয়োজন সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা না হলে ৬ কোটি টাকা দিয়ে মফস্বল শহরে এমন ওভার ব্রিজের কি দরকার আছে। কোন প্রকল্প নিতে হলে তো আগে জনমত যাচাই করা উচিত ছিল। এভাবে রাষ্ট্রের টাকার অপচয় রোধকে সরকারের কঠোর হওয়া দরকার।
একটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, কোন বিশ্ব ঐতিহ্যের কাছে এমন মহাসড়ক থাকতে পারেনা। এটা এই স্থাপনার গুলোর জন্য ক্ষতির। সেখানে বাগেরহাট খুলনা মহাসড়কটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাটের অন্যতম দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সিঙ্গাইর মসজিদের মাঝ দিয়ে এই সড়ক গেছে। এখান থেকে দ্রুতই এই সড়কটি বিকল্প স্থানে সরিয়ে নেওয়া দরকার। যে পদচারী সেতু এখানে হচ্ছে তা এই স্থাপনাগুলোর সৈন্দর্য্যহানী করবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বাগেরহাট যাদুঘরের দুজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, এই মহাসড়কটি বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদসহ প্রত্ন স্থানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মহাসড়ক দিয়ে ভারি যানবাহন চলাচলের সময় ষাটগম্বুজ ও সিঙ্গাইর মসজিদে কম্পন হয়। আগামী দিনের জন্য এই মহাসড়কটির বিকল্প ভাবনার এখনই সময়।
সামাজিকমাধ্যমে রাদিন সরদার নামে একজন লিখেছেন কোর্টের ফুটওভার ব্রিজে তো মানুষ মনের ভুলেও উঠবে না। আর ষাটগম্বুজের সামনে প্রতি জুম্মায় উঠতে পারে, তাও ছবি তোলার উদ্দেশ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আধুনিক শহর এবং সৌন্দর্যবর্ধনের কথা বলে পদচারী সেতু বানানো হচ্ছে। অথচ এখান দিয়ে বয়ষ্ক, প্রতিবন্ধী, অন্তঃসত্ত্বা নারী কিভাবে পার হবেন তার ব্যবস্থা নেই। এসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন হয় বুঝিনা।
এই সড়কে পদচারী সেতু অপ্রয়োজনীয় তা বলছেন খোদ সড়ক বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাগেরহাট সওজ’র তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী কথা বলেন এই প্রতিবেদককে সাথে। তাঁরা বলেন, ‘দেখেন আমরা তো চাকরি করি। কিছু বলতে পারবো না। আমরাও জানি এটা কোন কাজে আসবে না। বলেন মূল ফটক থেকে দূরে গিয়ে কে সেই সেতু পার হবে। আসলে বাজেটের সময় শেষে। এর মধ্যে প্রকল্প দেখিয়ে কিছু কাজ করানো। তা ছাড়া খুলনা বাগেরহাট হয়ে বরিশাল কুয়াকাটা পায়রা বন্দরের এই রাস্তা চার লেন করা একটি প্রস্তাব আছে। তা অনুমোদন হলে এই দুই লেনের জন্য পদচারী সেতু কোন কাজেই আসবে না।
পদচারী সেতু নিয়ে বিতর্ক এবং স্থানীয়দের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক বিভাগ বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো ফরিদ উদ্দিন বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটারের (আধা-সরকারি চিঠি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
এসআই/আইএইচ/বিআই/৭ জুন, ২০২৩