নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
১৪৪ ধারা জারির পরও বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলায় পূর্বঘোষিত স্থানে জনসভা করেছে জেলা বিএনপি।
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) বেলা সোয়া তিনটার দিকে সভা শুরুর আধা ঘণ্টা পর অবশ্য মূল সভামঞ্চ থেকে নেমে নেতা-কর্মীদের নিয়ে কিছুটা পূর্ব দিকে সাইনবোর্ড বাজারে এসে ট্রাকের ওপর করা অস্থায়ী মঞ্চে সভা শেষ করা হয়।
এদিন বিকেলে কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ রসিকলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জেলা বিএনপি ওই জনসভার আয়োজন করে। একেবারে কাছেই মাজেদা বেগম কৃষি প্রযুক্তি কলেজ (প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়) মাঠে আগে থেকেই কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ এইচ সেলিমের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেখানে বিএনপির আরেকটি পক্ষের নেতাদের যোগ দেওয়ার কথা ছিল।
জেলা বিএনপির বর্তমান নেতারা দীর্ঘদিন এলাকায় ও দলের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার অভিযোগ তুলে সাবেক সংসদ সদস্য সেলিমকে ‘দলের লোক নন’ বলে ঘোষণা দেন। এ নিয়ে উভয় পক্ষের নেতা-কর্মীদের উত্তেজনা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল সোমবার রাতে ওই দুই সভা এলাকা এবং আশপাশের এক কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে উপজেলা প্রশাসন।
মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম, সভা-সমাবেশ করা, আগ্নেয়াস্ত্র বহন নিষিদ্ধসহ ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও এর মধ্যেই জেলার বিএনপির জনসভা হয়েছে। মূল সভামঞ্চ থেকে নেমে কিছুটা দূরে গিয়ে সভা শেষ করা হলেও ওই এলাকা ১৪৪ ধারা জারি করা এক কিলোমিটার এলাকার ভেতরেই পড়েছে। এই জনসভাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
সকালে জেলা প্রশাসকের কক্ষে বিতণ্ডা
এর আগে সকালে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার চেয়ে জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসানের সঙ্গে দেখা করেন বিএনপির নেতারা। সেখানে জেলা প্রশাসকের কক্ষে প্রবেশের পর বিএনপি নেতাদের কয়েকজন হুমকি দেন এবং বেশ উচ্চ স্বরে কথা বলেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কয়েকজন কর্মীও সেখানে উত্তপ্ত বিতণ্ডার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা সভাস্থল কচুয়ার গোলামাঠ স্কুল মাঠ পরিদর্শনে যান। সেখান থেকে ফিরে জনসভা শুরুর আগে বেলা পৌনে একটার দিকে বাগেরহাট প্রেসক্লাবে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে জেলা বিএনপি।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ঘটা পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমি জানিয়েছি। এ নিয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করব না।’
দুই পক্ষের সংবাদ সম্মেলন
জেলা বিএনপি সংবাদ সম্মেলনে প্রশাসনের অসহযোগিতার কথা দাবি করে। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক টি এম আকরাম হোসেন সেখানে বলেন, ‘আমরা খবরটি জানার পর থেকে রাতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমরা কেউ যোগাযোগ করতে পারিনি। তাই সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে ১৪৪ ধারা জারির জন্য যে কথা বলা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি আমরা খুঁজে পাইনি। সাবেক এমপি (সেলিম) তিনি আমাদের দলের কেউ না। তাঁরা আমাদের সমাবেশ বন্ধ করতে পারেন না।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যেহেতু নেতা-কর্মীদের আগে থেকে বলা হয়েছিল, তাঁরা সবাই দূরদূরান্ত থেকে সভাস্থলে আসতে শুরু করেন। তাই তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে পাশে গিয়ে সভা করা হবে।
এদিকে জেলা বিএনপির এই সংবাদ সম্মেলনের পর বেলা পৌনে দুইটার দিকে প্রেসক্লাবে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে নিজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে বলে জানান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এম এ এইচ সেলিম। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘যেহেতু প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে, তাই আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্থগিত করতে বলেছি। ওই অনুষ্ঠান আপাতত হচ্ছে না।’
জেলা বিএনপির সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘আমি পরিস্থিতির কারণে কেবল দলের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। তা না হলে হয়তো আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হতো। আমি বিএনপির সদস্য পদ থেকে তো পদত্যাগ করিনি।’ দল ও কর্মীদের রক্ষার স্বার্থে এত দিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি এখনো জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আমি বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে সদস্য পদ নিয়েছি। এখানে বিএনপির একটি পক্ষ আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব ষড়যন্ত্র করছে।’
সাবেক সংসদ সদস্যের সংবাদ সম্মেলনে জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুর রহমান, জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি ফকির তারিকুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেহবুবুর হক, জেলা বিএনপির সদস্য আসাদুজ্জামান, সেলিমের বড় ছেলে মেহেদী হাসানসহ নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশের বাধার পরও যেভাবে জনসভাটি হলো
সরেজমিনে দেখা যায়, দুই অনুষ্ঠান ঘিরেই নির্ধারিত স্থানে আগে থেকে সভামঞ্চ ও প্যান্ডেল করেছিল দুই পক্ষ। তবে কারও সভাস্থলেই বসার জন্য চেয়ার সাজানো ছিল না।
বেলা সোয়া তিনটার মধ্যে জনসভাস্থলে বহু লোক জড়ো হন। জেলা বিএনপির নেতারা সেখানে আসার পর ওই মাঠে ট্রাক ভর্তি করে আনা চেয়ার নামানো হয়। এ সময় পুলিশ লোকজন সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও তাতে সফল হয়নি। এরপর প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী বিএনপি নেতারা ওই মঞ্চে বক্তব্য দেন। পরে তাঁরা ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ জানিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যান এবং পাশের সাইনবোর্ড বাজারে অস্থায়ী মঞ্চে সমাবেশ করেন।
জেলা বিএনপির এই জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক শামীমুর রহমান। কচুয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাজরা আছাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অহিদুজ্জামান দিপু, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ টি এম আকরাম হোসেন, সাবেক সভাপতি এম এ সালাম, সাবেক সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম খান, যুগ্ম আহ্বায়ক খাদেম নিয়ামুল নাসির, বিএনপি নেতা সরদার জাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শামীমুর রহমান বলেন, ‘দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। সিপাহি–জনতার ঐক্যবদ্ধ চেতনার মতো আমাদের ইস্পাতকঠিন ঐক্য ধরে রেখে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে হবে।’
জনসভায় বক্তারা ১৪৪ ধারা জারিকে কেন্দ্র করে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক এবং সাবেক দলীয় সংসদ সদস্য এম এ এইচ সেলিমের সমালোচনা করেন।
এসআই/আইএইচ/বিআই/১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪