• নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে ফাটল
• স্থানীয়দের জমি থেকে জোরপূর্বক মাটি কেটে নেওয়ার অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
‘বালির বাঁধ’, বাংলা ভাষার অতি প্রচলিত একটি বাগধারা। কোনো কিছু ‘ক্ষণস্থায়ী’ বোঝাতে যার ব্যবহার। অথচ বাগেরহাট সদর উপজেলায় জোয়ার, জলোচ্ছ্বাসের প্লাবণ থেকে স্থানীয়দের রক্ষায় একটি বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে ‘বালি’ দিয়ে।
ষাটের দশকে বাগেরহাট সদর উপজেলার ভৈরব নদ পাড়ে বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেই বাঁধটি নিচু থাকায় গেল কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমা অতিরিক্ত জোয়ারে নদের উপচে পানি প্লাবিত হচ্ছিলেন স্থানীয়রা। গেল নভেম্বরে বাঁধটি উঁচু করে নির্মাণে কাজ শুরু হওয়াতে খুশিই হয়েছিলেন স্থানীয়রা। তবে বাঁধ তৈরিতে বালু ব্যবহার করায় এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বাঁধ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাঁধের জন্য জোর পূর্বক তাদের বসতবাড়ি ও জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বাঁধের গোড়া দিয়ে নদের বালুচর কেটে গভীর গর্ত করা হচ্ছে মাটি নিতে। সরেজমিনে স্থানীয়দের এসব অভিযোগের সত্যতা মেলার পাশাপাশি নির্মাণ কাজ শেষের আগেই বাঁধের কয়টি অংশে ফাঁটল ও ধ্বসে যাওয়ার চিত্র দেখা গেছে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, বাঁধে কোথাও বালি দেওয়া নেই। আর কাজ চলমান আছে, ঢালটা আমরা পরে করি। এখনও ফিনিসিং হয় নাই, সুতরাং এখনই ধ্বসে যাচ্ছে এ কথা বলাটা সমুচিত না।
পাউবো’র তথ্য বলছে, বাগেরহাট শহরের বিপরীতে ভৈরব নদ পাড়ের ভাতছালা-মুনিগঞ্জ পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার বাঁধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০ লাখ টাকা। এর আওতায় পূর্বের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফিট উঁচু করা হবে বাঁধটি। জরুরি ভিত্তিতে নাজিরপুর উপ-প্রকল্পের অধীন ডিপিএম বা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এই বাঁধ তৈরির কাজ পেয়েছে ঠিকাদার শেখ শহিদুল ইসলাম। চলতি জানুয়ারি মাসেই শেষ হওয়ার কথা তিন মাস মেয়াদী এই প্রকল্পের কাজ। তবে বাঁধ নির্মাণের জন্য মাটি কিনে নেওয়ার কোন বরাদ্দ নেই। এরই মধ্যে নির্মাণ কাজের ৫০ ভাগের বেশি শেষ হয়েছে। তবে বাঁধের পুরো কাজ শেষ করতে প্রকল্পের সময় কিছুটা বাড়ানো হবে।
পূর্বের বাঁধটি নিচু থাকায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমা অতিরিক্ত জোয়ারে নদের পানি উপচে প্লাবিত হত স্থানীয় বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। তাই গেল নভেম্বরে বাঁধটি উঁচু করে নির্মাণের কাজ শুরু হওয়াতে খুশিই হয়েছিলেন স্থানীয়রা। তবে তারাই এখন নানা অনিয়মের অভিযোগ করছেন।
গত বৃহস্পতিবার ওই বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আশপাশের বিভিন্ন বাড়ি, বাগান, মাঠ, নদীর পাড় থেকে ছোট-বড় গর্ত করে মাটি খুড়ে নেওয়ার চিত্র। বাঁধের জন্য মুনিগঞ্জ খেয়া ঘাট থেকে লোকাল বোর্ড খেয়া ঘাট পর্যন্ত এলাকায় ভেকু মেশিন দিয়ে নদ তীরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মাটি-বালু তুলে করা অধিকাংশ গর্তগুলোই বাঁধ লাগোয়া। সেই গর্তের মাটি-বালু দিয়ে মাঝে ফাঁকা রেখে দু’পাশে উঁচু আইলে মত তৈরি করা হয়েছে। লোকাল বোর্ড খেয়া ঘাট থেকে ভাতছালা দিকে তৈরি করা এমন ফাঁকা স্থানের কিছুটা ভরাট করা হয়েছে বালু দিয়ে। যার কয়েকটি স্থান দেখা দিয়েছে ফাঁটল ও ধ্বস।
স্থানীয় চরগ্রামের মো. ডালিম শেখ বলেন, এমন কাজের কথা তো কোথাও শুনিনি। আমাগো বাড়ি-ঘর, বাগান, উঠোন সব জায়গা দিয়ে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। বাঁধের কাজ হচ্ছে, এলাকার সবার মঙ্গল। কিন্তু যেভাবে ১০-১৫ ফুট গভীন করে মাটি টুলে নিছে, এখন তো আশপাশ দিয়ে সব ধ্বসে যাবে।
একই গ্রামের শাহ জাহান শেখ বলেন, বাঁধের এক দোম গো দে মাটি কাটিছে। এই বাঁধ টেকপে কী হইরে? নদী পাড়, চর কাইটে নিয়ে আসতিছে। সেই মাটি-বালি দিয়ে বানলি বাঁধ থাকপে কোন দিন! কয়েক জাগায় দেখেন পুরো বালি, কাঁদা মাটি দিয়ে বাইধে গেছে। নদীর পাশের বাঁধের গোড়ার দে মাটি নিছে। পানির চাপ দিলি তো এক বারে ধইসে নদীতি চইলে যাবে।
চরগ্রামের ফাতেমা জোহরা বলেন, বাড়ির সামনে রাস্তা হচ্ছে। আমরা মাটি দিতিও চাইছি। দেখায় দিছি এখান দে মাটি নেন। তারপরও জোর করে আমার নারকেল গাছসহ বিভিন্ন গাছপালা তুলে এখানদে গভিন গর্ত করে মাটি তুলছে। নিষেধ করলেও শুনেনি। এখন দেখেন আমার বিল্ডিং এর পাশের উঠনে ফাঁটল ধরিছে।
বাঁধ নির্মাণের বিভিন্ন অনিয়োমের বিষয়ে প্রকাশে কথা বলতে ভয় পান স্থানীয়রা। তারা বলেন, স্থানীয় কিছু লোক আছে যারা এই অনিয়োমের সাথে জড়িত। তারাই প্রভাব খাটিয়ে বাড়ি, ফসলের মাঠ, বাগান দিয়ে জোর করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিক এমন এক ব্যক্তি বলেন, ‘আচ্ছা সরকার এত গরিব হয়ে গেছে, আমার উঠান কেটে মাটি নিতে হবে। এ তো জবর দখল। কারে বলবো বলেন, গ্রামের কিছু মানুষই তো বাধ্য করতেছে মাটি দিতে। কার নাম বলবো, সবাই তো আওয়ামী লীগ।’ একাধিক বার পানি অফিসে গেছি। তারা সিডিউলই কাউকে দেখায় না।’
সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য আসাদুজ্জামান মোহন, তার চাচাতো ভাই সুমন, চরগা গ্রামের ছোটসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাব বিস্তার করে মাটি কেটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তবে অভিযোগ অস্বিকার করে মো. মারুফ হোসেন ফকির ওরফে ছোট বলেন, এই রাস্তাটা আমাদের খুব দরকার ছিল। স্থানীয় মেম্বর বলায় আমি আগা-মাথা মাটি কাটার সময় সাথে ছিলাম। সবাই সেচ্ছায় এই কাজের জন্য মাটি দিচ্ছে। কাউকে চাপ দেওয়া হয়নি। মেম্বের বলেছে চারফুট উঁচু রাস্তা হবে। তবে কাজ যেভাবে হচ্ছে- রাস্তার পাশ দিয়ে মাটি কাটা হয়েছে, তাতে অনেক জাগয়া দিয়েই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলছেন তিনিও।
বাঁধের একদম টোর (গোড়া) থেকে ৪-৫ ফিট দূর থেকে ছাড়া মাটি কাঁটা উচিৎ না বলে জানান পাউবোর এক কর্মকর্তা। আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রজি না হলেও তিনি বলেন, নদীর চরের মাটি কেটে নিলে সেখানে আবার পলি জমে ভরাট হয়ে যাবে। আর কাজ শেষে দুই পাশে আমরা ঘাস লাগাবো। তখন আর বাঁধ ধুয়ে যাবে না।
বাঁধ নির্মাণের ঠিকাদার শেখ শহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ২২ বছর পর এই বাঁধের সংস্কার হচ্ছে। এটা ইমারজেন্সি কাজ। গ্রামবাসীর সহযোগীতায় আমরা কাজটা করছি। এখানে মাটি কিনে নেওয়ার কোন বরাদ্দ সিডিউলে নেই।
পাউবোর বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, দরপত্র অনুযায়ী এই বাঁধটা ৩ দশমিক ৫ লেভেলে হবে। যাতে কোথাও দুই-তিন ফুট, কোথাও চার ফুট উঁচু হবে। জরুরি ফান্ড থেকে এই কাজটি করা। দরপত্রে বলা আছে, মাটি ও লোকাল ম্যাটেরিয়াল দিয়ে দিয়ে কাজটি করতে হবে। এই কাজে জমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের কোন সংস্থান আমাদের নেই।
‘মাটি ছাড়া লোকাল ম্যাটেরিয়াল স্যান্ড (বালি) হতে পারে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বালু ব্যবহার করা যাবে। তবে মাটির পরিমানই বেশি থাকবে। বালুটা আমরা মাঝেই দেই। তবে চেষ্টা করি যত কম দেওয়া যায়।
আর বাঁধ পুরো বালু দিয়ে করা হচ্ছে এরকম কোথাও নেই দাবি করে পাউবোর ওই কর্মকর্তা বলেন, আমি পুরো দুই কিলোমিটার হেটে দেখছি। কোথাও বালি দেওয়া নেই।
এসআই/আইএইচ/বিআই/১১ জানুয়ারি, ২০২৩