ইনজামামুল হক
প্রাচীন স্থাপনার জন্য বিশ্ববিখ্যাত ২৫টি ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদের শহর বাগেরহাট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে থাকা সাংস্কৃতিকভাবে উল্লেখযোগ্য এসব স্থানের তালিকা করেছে ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ওয়াচ’।
ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ওয়াচ মূলত ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ড (ডব্লিউএমএফ) দিয়ে পরিচালিত একটি প্রকল্প। বিশ্বজুড়ে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যেসব স্থান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ভারসাম্যহীন পর্যটন ও কম প্রচারের কারণে পিছিয়ে পড়ছে; সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে সহায়তা দেওয়া এবং এসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে ডব্লিউএমএফ।
সম্প্রতি ডব্লিউএমএফ ২০২২ সালের এ তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রতি দুই বছর পরপর তারা এ তালিকা প্রকাশ করে আসছে।
ডব্লিউএমএফ বলছে, এবারের তালিকায় অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ যে ২৫টি ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে, তা ১২ হাজার বছরের ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে।
সংস্থাটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এবারের তালিকা তৈরির জন্য ২২৫টির বেশি স্থানের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে ২৫টি স্থানকে ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ওয়াচ। মসজিদের শহর বাগেরহাট এ তালিকায় স্থান পাওয়া বাংলাদেশের একমাত্র স্থান।
এ তালিকায় আছে ভারতের কলকাতার ‘চায়না টাউন’খ্যাত টেরিবাজার, পাকিস্তানের লাহোরের জাহাঙ্গীরের সমাধি, লিবিয়ার ঐতিহাসিক বেনগাজি শহর, যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামার আফ্রিকা টাউন।
ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বা মসজিদের শহর বাগেরহাট বলতে মূলত পনেরো শতকে ইসলাম ধর্মপ্রচারক ‘খান উল আযম উলুঘ খান ই জাহানে’র হাত ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভৈরব নদের তীরে গোড়াপত্তন হওয়া তৎকালীন নগরী বা শহরকে বোঝায়। ‘খলিফাতাবাদ’ নামের তৎকালীন শহরটি বিশ্বখ্যাত ফোর্বস সাময়িকীতে প্রকাশিত বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি ঐতিহাসিক নগরীর অন্যতম। কালের বিবর্তনে যা এখন বাগেরহাট।
প্রাচীন এই শহরকে ১৯৮৫ সালে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ৩২১ নম্বর ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো। শহরের ঐতিহ্যবাহী ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ, উলুঘ খানজাহানের সমাধিসৌধ, নয় গম্বুজ মসজিদ, খানজাহানের নির্মিত প্রাচীন রাস্তা, জিন্দাপীর মসজিদ, বিবি বেগনী মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, রনবিজয়পুর মসজিদ, সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি। সমৃদ্ধ প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরের এমন অসংখ্য স্থাপনা সময়ের সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে।
এক বিবৃতিতে ডব্লিউএমএফের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী বেনেদিক্তে দে মঁৎলাউ বলেন, এ বছরের ওয়াচে দেখানো হয়েছে যে ঐতিহ্য সংরক্ষণ একই সঙ্গে চলমান বিশ্বের সংকটগুলো মোকাবিলারও উদ্ভাবনী সমাধান দিতে পারে। এসব অনন্য সাংস্কৃতিক গুরুত্বসমৃদ্ধ স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াতে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এসব স্থান সমাজের বৃহত্তর সংকটগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর স্বীকৃতির চাহিদা, প্রবেশাধিকার, অংশগ্রহণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির বিষয়গুলো সমাধানের পথ দেখাতে পারে।
ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ডের এ বছরের মনোনয়নের জন্য গবেষণার কাজে নিযুক্ত ছিলেন বাংলাদেশি তরুণ গবেষক ও স্থপতি ইমামুর হোসেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। গাঙ্গেয় বদ্বীপে অবস্থিত বাগেরহাটের এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দীর্ঘ সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এই এলাকার স্থাপনাগুলো সব সময়ই ঝুঁকিতে আছে।
জলবাযু পরিবর্তণের প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধির মত ঝঁকির সাথে সাথে স্থানীয় নানা বিষয়ও প্রত্নত্ত্বগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। স্থানীয়ভাবে লাভজনক হওয়ার কারণে ওই অঞ্চলে কৃষক ধান চাষের চেয়ে চিংড়ি ঘেরে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, যার পরিণতিতে কৃষি জমিতেও দিনে দিনে লবণাক্ততা বেড়েছে, বাড়ছে।২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ডের তলিকায় স্থান পাওয়া সাইটগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখবে। যাতে এই সাইটগুলোর কোন ক্ষতি না হয় এজন্য পরিবেশগত এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলো মোবেলায় পরবর্তিতে অ্যাক্সানপ্লান তৈরি করা হবে।
এ তালিকায় বাগেরহাটের সঙ্গে স্থান পাওয়া অন্য স্থানগুলো হলো-
১. কলকাতার ‘চায়না টাউন’ খ্যাত টেরিবাজার,
২. পাকিস্তানের লাহোরে জাহাঙ্গীরের সমাধি,
৩. লিবিয়ার ঐতিহাসিক বেনগাজি শহর,
৪. যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামার আফ্রিকা টাউন ও
৫. টেক্সাসের গার্সিয়া চারণভূমি,
৬. যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পশায়েরর হার্স্ট কাসেল,
৭. লেবাবননের বৈরুতের ঐতিহ্যবাহী ভবন,
৮. অস্ট্রেলিয়ার কিনচেলার কিনচেলা অ্যাবোরিজিনাল বয়েজ ট্রেইনিং হোম,
৯. ক্যাম্বোডিয়ার মোনদুলকিরি প্রদেশের বুনোং জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপ,
১০. চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের ইয়াংতাইয়ের দূর্গ-প্রসাদ,
১১. ইন্দোনেশিয়ার সুম্বা দ্বীপ,
১২. নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকার হিতিস (ঝরনা)
১৩. সুদানের নুরি,
১৪. বেলিজের ভারতীয় গির্জা গ্রাম- লামানাই,
১৫. ব্রাজিলের মন্তে আলেগ্রে স্টেট পার্ক,
১৬. বার্কিনা ফাসোর উয়াগাদুগুর লা মাইসন দু পিউপিল,
১৭. মিসরের আবিদোস,
১৮. ঘানার আসান্তে ঐতিহ্যবাহী ভবন
১৯. মালদ্বীপের কোয়াগানু মসজিদ ও সমাধিক্ষেত্র
২০. মেক্সিকোর সান হুয়ান তিওতিহুয়াকানের তিওতিহুয়াকান,
২১. পেরুর মিরাফ্লোরেস জেলার ইয়ানাকানচা-হুয়াকিস সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপ,
২২ পর্তুগালের লিসবনের মেরিন স্টেশনের (আলমাদা নেগরেইরোস মুরাল), আলকানতারা অ্যান্ড রোচা দো কোন্দে দে ওবিদোস,
২৩. রোমানিয়ার তিমিসোয়ারার ফেব্রিক সিনাগগ ও তিমিসোয়ারার ইহুদি ঐতিহ্য, এবং
২৪. ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ।
ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ওয়াচ ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতি দুই বছর পর পর এ ধরনের তালিকা প্রকাশ করে আসছে। ডব্লিইউএমএফ এর সদরদপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে। এছাড়া ভারত, যুক্তরাজ্য, পেরু, স্পেন, পর্তুগাল, কম্বোডিয়ায়ও সংস্থার কার্যালয় ও কার্যক্রম রয়েছে।
এসআই/আইএইচ/বিআই/১৫ মার্চ, ২০২২