বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় চরম ক্ষতির মুখে দেশের চিংড়িশিল্প। গত এক মাসে বিদেশি ক্রেতারা রপ্তানিকারকদের ২৯০টি ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন, যার আর্থিক মূল্য ৪৬০ কোটি টাকা।
এসব কারণে মাছ কোম্পানিগুলো আপাতত চাষিদের কাছ থেকে মাছ কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু কারখানা শ্রমিকদের ছুটি দিয়েছে। খবর প্রথম আলো।
শুধু বাগেরহাটের মোংলা ও রামপাল উপজেলার ৫ লাখের বেশি মানুষ তাঁদের ৯০ ভাগ জমিতেই বাগদা চিংড়ি চাষ করে থাকেন। তাঁরা সরকারের কাছে দ্রুত সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন।
মোংলা ও রামপাল উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, লোনাপানি-অধ্যুষিত মোংলা ও রামপালে প্রায় তিন যুগ আগে থেকে ধানের পরিবর্তে বছরের প্রায় আট মাসই বাগদা চিংড়ি চাষ হয়ে আসছে। মোংলার ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ১০ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমিতেই বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়। আর এ পরিমাণ জমির মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে ঘেরের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৫০।
রামপালের ১৪ হাজার ৮৮১ হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। এর মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে বাগদা চিংড়ির ঘেরের সংখ্যা ৪ হাজার ৮৬৫। ধান বা অন্য কোনো ফসল না হওয়ায় এ দুই উপজেলার অধিকাংশ মানুষই চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল।
মোংলার চিলা, আন্ধারিয়া, বুড়বুড়িয়া, জয়খা গ্রামের বাসিন্দা সত্তার ইজারাদার, মহিদুল, লাবলু গোলদারসহ আরও কয়েকজন ঘের ব্যবসায়ী বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে ঘেরে পোনামাছ ছেড়েছি। এপ্রিল মাস থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করার কথা। কিন্তু সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে মাছ কোম্পানিগুলো মাছ কিনছে না। কবে আবার কিনবে, সে বিষয়ে আমরাও সন্দিহান। পাশাপাশি যদি চিংড়ির দাম কমে যায়, তাহলেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আতঙ্কে আছি।’
রামপালের পেড়িখালী ইউনিয়নের পেড়িখালী গ্রামের চিংড়িঘের ব্যবসায়ী হুমায়ুন ইজারাদার বলেন, ‘আমার ৪০ বিঘা জমিতে এবার বাগদা চাষে প্রায় ১০ লাখ টাকা লগ্নি করেছি। চলতি মৌসুমের মাঝামাঝি এ ঘের থেকে যে পরিমাণ মাছ পাওয়ার আশা করছি, তাতে আমার এ খাতে লগ্নি করা টাকার অধিকাংশই উঠে আসার কথা। কিন্তু করোনার কারণে মাছই বিক্রি করতে না পারলে আমি শেষ হয়ে যাব।’
মোংলা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা এ জেড এম তৌহিদুর রহমান ও রামপাল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শেখ আসাদুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। তার প্রভাব তো অবশ্যই চিংড়িশিল্পের ওপর পড়বে। সম্প্রতি কাঁকড়া রপ্তানির ক্ষেত্রেও এলাকার চাষিরা সমস্যায় পড়েছিলেন। তাই চাষিদের বিষয় নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিংড়ি রপ্তানিকারক জালালাবাদ ফ্রোজেন ফুডস লিমিটেডের পরিচালক মারুফ বিন আবদুল জব্বার বলেন, ‘আমরা যারা বিদেশে চিংড়ি রপ্তানি করি, তারাও খুব বিপদে আছি। গত মাসে ইউরোপে আমার ১৫ কোটি টাকার চিংড়ি শিপমেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে বিদেশি ক্রেতা সে ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। আরও প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে ক্রেতা।’
‘গেল দুই মাসে আমার প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। একই অবস্থা অন্য রপ্তানিকারকদেরও। যেহেতু ক্রেতা নেই, তাই মাছও কিনছি না। মাছ না কিনলেও শ্রমিক মজুরিসহ কারখানায় আমার প্রতিদিন খরচ আছে ১২ লাখ টাকা। তাই চিংড়িশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, দেশে ১০৫টি হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও মাত্র ৩০-৩৫টি কারখানা রপ্তানিতে সক্রিয়। ইতিমধ্যে এসব কারখানায় ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ ২৯০টি চিংড়ির ক্রয়াদেশ বন্ধ এবং বাতিল করে দিয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ৪৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন কারখানায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার অবিক্রীত চিংড়ি মজুত আছে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা-ও অনিশ্চিত।
ভয়াবহ দুঃসময় চলছে এ শিল্পের। ইতিমধ্যে কিছু কারখানায় শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। এখানে নিয়োজিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬০ লাখের বেশি লোকের জীবিকা নিশ্চিতকরণের জন্য রপ্তানি কার্যক্রম চালু রাখার বিকল্প নেই। তাই চিংড়িশিল্প রক্ষায় সরকারকে দ্রুত চাষি ও কারখানামালিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
পিআর/আইএইচ/বিআই/২৯ এপ্রিল, ২০২০