মনজুর মোরশেদ প্রিন্স, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
করোনাভাইরাসের আধিপত্যে স্থবির গোটা বিশ্ব। দেশেয় প্রায় সব ধরণের ছোট বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনা সংক্রামণ রোধে ঘরে থাকই সমাধান। কিন্তু দৈনিক উপার্যনে যাদের সংসার চলে, এমন পরিস্থিতিতে তারা হয়ে পড়েছেন কর্মহীন।
ঘরে থাকতে হবে। কিন্তু খাবার নেই তাদের ঘরে। বাইরে কাজ নেইও, ফলে বন্ধ উপর্যনের সুযোগ। তারপরও যারা কাজে যাচ্ছেন, আয় হচ্ছে সামান্যই। কর্মহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন-শ্রেণি পেশার মানুষের তাই বড় চাহিদা খাবারের। বিশেষ করে গ্রামের দৈনিক উপার্যনে চলা পরিবারগুলো অবস্থা বেশি শোচনীয়।
বিষয়টি পীড়া দিচ্ছিল মো. ফোরকানুন নেওয়াজকে। তিন বছর হলো তাঁর ফ্রিল্যান্সিং যাত্রা শুরু। গ্রামে থেকেই অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে (মার্কেটপ্লেস হিসেবে পরিচিত) কাজ করে পরিবারের হাল ধরেছেন এই তরুণ। করোনার এই সময়ে চাইছিলেন আশপাশের অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে, তাদের পাশে দাঁড়াতে।
ফোরকানুন নেওয়াজের বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের কোন্ডলা গ্রামে।
নিজের সীমিত সামর্থ্য দিয়েই চেয়েছিলেন শুরু করতে। কিন্তু খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলেন গ্রামের অধিকাংশ দরিদ্র দিনমজুর পরিবারের ঘরেই খাবার নেই। তখন ভাবনাগুলো নিয়ে কথা বলেন বর্তমানে তিনি যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেন সেই ইয়োলো লায়ন স্টুডিওর প্রধান নির্বাহীর সাথে।
বিষয়টি জেনে জার্মানের ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মি. আর্নি ছাওয়ারও তাঁকে উৎসাহ দেন। আশ্বাস দেন সহযোগীতার। বন্ধুদের নিয়ে গ্রামে অসহায়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে কাজ করছেন ফোরকানুন।
ফোরকানুনের বাবা মো. নূর ইসলাম শেখ। ছেলের এই উদ্যোগে কাঠমিন্ত্রি বাবা এগিয়ে এসেছেন সবার আগে। তিনি বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। ফোরকানুন মেঝ। বড় ছেলে আগে দিনমজুরের কাজ করত। কদিন আগে মেঝটা ওকে একটা ইজিবাইক কিনে দিয়েছে। এখন ইজিবাইক চালায়। মেয়েটা পাড়াশোনা করে।’
‘আমরাও আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছ্বল না। কাঠের ঘর আমাদের। বাড়ির সামান্য জমি ছাড়া আর কোন জমিজমাও নেই। অভাবের সাংসারেই বড় হয়েছে ওরা। এখন ছেলেই সংসারের হাল ধরেছে। বাড়িতে বসেই ওরা এসব খাবার প্যাটেক করছে। এমন কাজে ওদের পাশে থাকতে পেরে আমি গর্বিত।’
বাবা ও পরিবারের সদ্যসদের পাশাপাশি ফোরকানুনের ৭ বন্ধুও স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে খাদ্যসামগ্রী প্যাকেট করে বাড়ি বাড়ি পৌছে দিতে। তাদেরই একজন মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, আসলে এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। একটা অসহয় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারার আনন্দটা সত্যিই অসাধারণ। অনেক নিম্ব মধ্যবিত্য পরিবার আছে যারা বলতেও পারছেন না তাদের ঘরে খারার নেই। আমরা খোঁজ নিয়ে নিয়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। একটা ফোন নম্বরও আমরা গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছি। কারও খাবারের প্রয়োজন হলে যেন যোগাযোগ করতে পারে।
কোন্ডলা গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী উত্তম কুমার দেবনাথ বলেন, দরজির কাজ করে সংসার চলত। কিন্তু এখন কিছুই করতে পারছি না। দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। এরা কিছু খাবার দিছিল যা দিয়ে এখন চলছে।তাদের এই উদ্যোগে অভিভূত গ্রামের সাধারণ মানুষও। ফোরকানুন ও তার বন্ধুদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে শুভকানা জানিয়েছেন তারা।
বেমরতা ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনিন্দ্রনাথ দেব বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, করোনার মধ্যেও ফোরকানুন নামের একটি ছেলে আমাদের গ্রামে উদ্যোগ নিয়ে সত্যিকারের গরিব দুখিদের খাদ্য সামগ্রী দিচ্ছে। এলাকার গরিবদুঃখী মানুষের জন্য সে যা করছে, তা সত্যিই অনুকরণীয়। সবাই যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে এলে কোন পরিবারকে না খেয়ে দিন কাটাতে হবে না।
জার্মানের ইয়োলো লায়ন স্টুডিওর হয়ে কাজ করতে করতে ফোরকানুন নেওয়াজ এখন প্রতিষ্ঠানটির একজন অংশিদার। তিনি বলেন, বর্তমানে মি. আর্নির প্রতিষ্ঠানের প্রধান গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছি। আমি নিজের সামর্থ অনুযায়ী যতটুকু পারি তা দিয়েই কাজ করতে চেয়েছিলাম। আর্নির কাছে সহযোগীতা চাওয়ার ভাবনা ছিলনা। প্রায় এক মাস আগে আর্নির স্ত্রী আমাকে একটি উপহার পাঠাতে চেয়েছিল। আমি তখন তাকে বলেছিলাম আমি তো ভালো আছি। আমার কিছু দরকার নেই। আমাদের গ্রামে করোনার কারনে কাজহীন অনেক মানুষ আছে যাদের ঘরে খাবার নেই। আপনি আমাকে না দিয়ে ওই টাকাটা ওদের জন্য দিতে পারেন।
পরে বিষয়টি নিয়ে আর্নির সাথে কথা হয়। সে আমাকে কিছু টাকা পাঠায়। এর সাথে নিজের জমানো টাকা দিয়ে কাজটা শুরু করি। যেহেতু করোনার এই সময় দীর্ঘ হচ্ছে তাই আর্নি আমার সাথে কথা বলে একটি ওয়েব সাইট করেছে। সেখানে আরও কিছু সহযোগীতা এসেছে। এটা পুরোপরি ট্রান্সপারেন্ট। আর্নির আত্মিয় স্বজনও সহযোগীতা করেছেন।
এখন পর্যন্ত আমরা ৭৯০ ইউরো সংগ্রহ করেছি। আমারা এই কাজ চালিয়ে যেতে চাই।
মি. আর্নি ছাওয়ার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস ইউরোপও প্রায় সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। সেখানে সরকার মানুষকে রক্ষায় ঘরে রাখতে লকডাউন দিয়েছে। জার্মানিতেও প্রায় একই অবস্থা।’
‘এই পরিস্থিতিতে ফোরকানুনের সাথে কথা হলে সে তাঁর গ্রাম কোন্ডলায় কিছু পরিবারকে সাহায্য করতে চাইছে বলে জানতে পারি। তারপর আমাদের আইডিয়া নিয়ে একটি ওয়াবসাইট তৈরি করি। আমরা সেখানে সব কার্যক্রম তুলে ধরেছি।’
বর্তমান সময়ে ফেরকানুন ও তার দল বাংলাদেশে তাদের গ্রামে অসাধারণ কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তারা কোন্ডলা গ্রামে অসহায় পরিবারগুলোর জন্য খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। আমি এই কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে পেরে গর্বিত।’
কোন্ডলা গ্রামে রোববার পর্যন্ত ৭৭টি পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে ফোরকানুনরা। প্রতিটি পরিবারকে তারা চাল, ডাল, তেল, আলু, লবন, পেয়াজ ও সাবান পৌঁছে দিয়েছে।
ফোরকানুন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমরা আসেলে ঘুরে ঘুরে দেখতেছি সমস্যাটা কোথায়। কার ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই। কাদের প্রয়োজন।
‘আমি আমার ফিল্যান্সার ভাইদের বলতে চাই। আপনারা যারা দীর্ঘদিন ধরে ফিল্যান্সিং এর সাথে যুক্ত আছেন, আপনার যে ক্লায়েন্টের সাথে এমন একটা ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে। তাদের এমন একটা প্রস্তাব দিতে পারেন। আমার মনে হয় তারাও সহযোগীতা করবেন। সাথে আপনার সামর্থ অনুযায়ী যদি আপনার গ্রামের ৫-১০টি করে পরিবারকেও দেখতে পারেন, বাংলাদেশে করোনা সংকটে কোন পরিবারকে অন্তত না খেয়ে থাকবে না।’
এসআই/আইএইচ/বিআই/২০ এপ্রিল, ২০২০