শিক্ষার্থীদের দেখতে দূর প্রবাস থেকে ছুটে এলেন তিনি

‘আমি এখানে এসে অভিভূত’ – কীয়ান রাশেদ সাদী।

ইনজামামুল হক, বাগেরহাট

যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি থেকে বাংলাদেশের বাগেরহাট, দূরত্বটা প্রায় ১৩শ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে এলেন এক তরুণ। আর তাঁর জন্য বাগেরহাটের প্রান্তিকগ্রাম চিতলী-বৈটপুরে আগে থেকে অপেক্ষায় এক ঝাঁক শিশু-কিশোর।

যাদের মধ্যে ১৪ জন তাঁরই শিক্ষার্থী। সামনাসামনি কখনো দেখা না হলেও গত ৯ মাস ধরে অনলাইনের মাধ্যমে এই শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়ান ১২ গ্রেডের শিক্ষার্থী কীয়ান রাশেদ সাদী। 

সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) সেই শিশুশিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে বাগেরহাট সদরের উদ্দীপন বদর-সামছু বিদ্যানিকেতনে আসেন তিনি। কম্পিউটার লিটারেসি প্রোগ্রামের (সিএলপি) আওতায় দূরশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের এই বিদ্যালয়টিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ক্লাস নেন নিউজার্সির হিলসবোরোজ হাইস্কুলের শিক্ষার্থী কীয়ান। বিদ্যালয়টির নিয়মিত শিক্ষক-শিক্ষিকার পাশাপাশি সিএলপি কর্মসূচির আওতায় অনলাইনে চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণিতে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস নেন কীয়ানের মতো আরও ১১ জন।

রোববার রাতে বাংলাদেশে পৌঁছে গতকাল ভোরেই কীয়ান তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রওনা হন বাগেরহাটের পথে। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তিনি বাগেরহাটের চিতলী–বৈটপুর এলাকার বিদ্যালয়টিতে এসে পৌঁছান। এ সময় মা–বাবা, ছোট ভাই ছাড়াও সঙ্গে ছিলেন কীয়ানের নানা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। সেখানে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ, পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় তাঁদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানান।

পরে বিদ্যালয়টির সভাকক্ষে সিএলপির অধীনে ২০২০ সালের দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন রাশেদ খান মেমন। উপস্থিত ছিলেন সমাজসেবা বাগেরহাট কার্যালয়ের উপপরিচালক এস এম রফিকুল ইসলাম, সামছুদ্দিন নাহার ট্রাস্টের ট্রাস্টি মো. শফিক, প্রধান সমন্বয়ক সুব্রত কুমার মুখার্জি, উদ্দীপন বদর-সামছু বিদ্যানিকেতন প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর পাল প্রমুখ। 

অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে কীয়ান সাদী তাঁর শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলে যান ক্লাসে। চতুর্থ শ্রেণির ১৪ জন শিক্ষার্থী সেখানে তাঁর সঙ্গে গল্প আড্ডা আর নানা বিষয়ে কথা বলে। লেখার বিষয়বস্তু ও কীভাবে ইংরেজিতে লেখার মান ভালো করা যায় তা নিয়ে কথা বলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাদের টি-শার্ট ও চকলেট উপহার দেন।

কীয়ান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘সিএলপির মাধ্যমে এটা দূর থেকে পড়ানোর কার্যক্রম। আমিও বাংলাদেশি বংশভুত রিত্তিকা সামসুদ্দীন নামের এক নারীর মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারি এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেব যুক্ত হই। চলতি বছরের মার্চ থেকে আমি এই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছি। সম্পাহের ছুটির দিনে আমি ক্লাস নেই। এটা আমার খুবই ভালো লাগে। আমি কিছু করতে পারছি।’

`আমি আসলে মানুষকে সাহায্য করতে চাই। সেখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) আমি যা জানছি তা এখানকার সবার সাথে ভাগ করছি।’‘আমি অনেক দূরে থাকি। আমার এখানে আসার সবচেয়ে বড় কারণ আমি তাদের সেভাবে চিনি না। তারাও হয়তো আমাকে জানেনা। পড়ানোর ক্ষেত্রে এটা খুব জরুরি। আমি আসলে এই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে একটি যোগাযোগ স্থাপন করতে চেয়েছি। এবং এখানে এসে আমি সত্যিই অভিভূত।’

সামছুদ্দিন নাহার ট্রাস্টের প্রধান সমন্বয়ক সুব্রত মুখার্জী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, চিতলী গ্রামের প্রয়াত সামছুদ্দীন আহমেদ ও রেসাতুন নাহারের সন্তানরা এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেন। নিজেদের পারিবারিক জমি দান করে প্রতিষ্ঠানটি গোড়ে তোলেন তাদের ৬ ছেলে ও ২ মেয়ে। ২০০২ সালে ট্রাস্টের যাত্রা। তখন থেকে এর অধিনে বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু।

তবে নানা সংকটের মাঝে গ্রামের স্কুলের জন্য ভালো মানের শিক্ষক পাওয়াটা তাদের জন্য ছিল সবচে বড় চ্যালেজ্ঞিং। এখন এখানে পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সূহৃদরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনলাইনে বিভিন্ন ক্লাস নেন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এই দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের ভালো সাড়া মিলছে।

কীয়ান মা সুবর্ণা আফরিন খান ও বাবা শামসুল কবীর সাদী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘রোববার রাতে আমরা ঢাকা এসে পৌঁছাই। এখানের শিশুরা কীয়ানের অনুপ্রেরণা। তাই সকালে উঠেই আমরা এখানে রওনা হই। সে বিদেশে যা শিখছে এখানের বাচ্চাদেরকে সেটা দিতে চাচ্ছে। অভিভাবক হিসেবে এটা আমাদেরও ভালো লাগায়। শুধু আমেরিকা থেকে নয় দেশের ভেতর থেকেও এই চর্চা শুরু হতে পারে। তবেই আমরা দ্রুত আরও এগিয়ে যাবো।’

‘কীয়ান এখানে ভলেন্টিয়ার হিসেবে ক্লাস নেওয়া শুরু করার পর আমরা তার ভেতর দারুন একটা দারুণ পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। এই যে কার্যক্রমটা শুরু হয়েছে এটা ধরে আমরা যদি আগাতে পারলে, আরও অনেকে যুক্ত করতে পারি তবে বিশ্বাস করি এটা দারুন কাজ হবে।’

অনুষ্ঠান শেষে রাশেদ খান মেমন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি নানা হিসেবে, আমার নাতীর সাথে। নতুন প্রজন্মের সাথে এখানে এসে আমি দেখছি কিভাবে তাঁর কাজ করছে। সুদূর প্রসাবের একজন অ্যামেরিকানের সাথেও আমাদের গ্রামের শিশুদের ইন্টারঅ্যাকশনটা গত গভীর হতে পারে এখানে এসে আমি তা দেখলাম। এই শিশুরা অনেক মেধাবী। শুরু তাদের সুযোগটা দেওয়া দরকার।’

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে শিক্ষার প্রসারে এই বিষয়টি আরও ঢেলে সাজানো দরকার। আমি প্রবাসী ছাড়াও দেশের মধ্যে যারা আছেন সবাইকে আহ্বান জানাবো যাদের হাতে সময় থাকে কোচিং ক্লাসে না দৌড়ে তারা যদি এভাবে অন্যদের শেখাতে উদ্যোগী হন। তা অনেক বেশি কাজে লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।

আইএইচ/আইএইচ/বিআই/২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯