সাম্প্রতি ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষামন্ত্রী, সচিব ও জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেন কলেজের ২৪ শিক্ষক।
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বাগেরহাট সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার খবরে ছাত্রীদের বিক্ষোভ থেকে অধ্যক্ষের অপসারণের দাবি তোলা হয়েছে।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) সকালে ছাত্রীরা কলেজে এসে জানতে পারেন অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামানকে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যা শুনে ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এক পর্যায়ে ক্লাস বর্জন করে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা।
এদিকে অধ্যক্ষ ড. এস. এম. রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে তাঁর অপসারণ দাবিতে ছাত্রীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষক। কলেজের গাছ কেটে বিক্রি ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, বিভিন্ন পরীক্ষা কমিটি থেকে অর্থ আদায়, পিয়ন-কর্মচারীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, পরীক্ষা থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ ১৬ অভিযোগে সাম্প্রতি ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষামন্ত্রী, সচিব ও জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেন কলেজের ২৪ শিক্ষক।
তবে অধ্যক্ষের দাবি, ওই সব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর সুনিদৃষ্ট অভিযোগেই একজন শিক্ষকে কারণ দর্শাতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, অর্থনীতির শিক্ষক আসাদুজ্জামান কলেজের আইসিটি (ICT) ক্লাস নেন। তাঁকে দেওয়া নোটিশে বলা হয়েছে, ‘আইসিটি ক্লাস চলাকালীন অসৌজন্যমূলক আচারণ ও অধ্যক্ষের রুমে ছাত্রীদের সংঙ্গে উদ্ধৌত্বপূর্ণ আচারণের কারণে কলেজের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।’ অভিবাবক ও ছাত্রীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কেন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবেনা আগামী তিন কার্মদিবসের মধ্যে এ বিষয়ে তাঁকে কারণ দর্শাতে বলা হয়। একই সাথে ওই অভিযোগে তাঁর আইসিটি ক্লাস গ্রহণ বন্ধ থাকবে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যক্ষ ড. এস এম রফিকুল ইসলাম কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে আইসিটি ক্লাস থেকে বাদি দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দেননি। অধ্যক্ষ এই কলেজে ৪ বছর ধরে আছেন। যোগদানের পর থেকে ক্যাম্পাসের গাছ কেটে বিক্রি করেছেন। পুকুরের মাছ ধরে নেন। অধ্যক্ষের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তার সব ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষনা দেন। এসময় শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন, কলেজে ভর্তির সময় আমরা পরিচয়পত্র, কলেজ বাসের ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে টাকা দেই। অথচ আমরা এসব কোন সুযোগ সুবিধা পাইনা। ভর্তির সময় টাকা নেওয়া হলেও পরিচয়পত্র দেওয়ার সময় নতুন করে আবার টাকা দিতে হয়েছে। মাসে মাসে টাকা দিয়েও আমরা কলেজের বাসে উঠতে পারিনা।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অধ্যক্ষ স্যারকে বলতে হবে কোন ছাত্রী অভিযোগ করছে। আমরা কোন ছাত্রী ওই অভিযোগ করিনি। আমাদের সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের এক সাথে আইসিটি ক্লাস হয় বলে আমরা স্যারের কাছে গেছিলাম আমাদের ক্লাস যেন আলাদা করে নেওয়া হয় সেই দাবি জানাতে।
মানবিক বিভাগের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন, যে শিক্ষক দিয়ে আমাদের কোন লাভ হয়না। তাকে আমরা চাইনা। বিভিন্ন সময় স্যারের কাছে গিয়ে আমরা আমাদের প্রয়োজন ও দাবি কথা বললেও তিনি কোন উদ্যোগ নেন না।
অধ্যক্ষের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত কোন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যাবে না বলে হুশিয়ারী দেন একাধিক শিক্ষক। তাদের অভিযোগ, সাম্প্রতি দুর্গাপূজার ছুটির সময় কলেজের একটি গাছ গোপনে কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় ভিডিও করেছিলেন ওই শিক্ষক। সেই ক্ষোভে তাঁর বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ তোলা হয়েছে।
কলেজের বাংলা বিভাগে শিক্ষক এবিএম হাসানুজ্জামান বলেন, অধ্যক্ষ স্যার কলেজের গাছ কেটে বিক্রি, কর্মচারিদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচারণ এমনকি নারী কর্মচারিকে মারধরও করেছেন। শিক্ষকদের দিয়ে বিভিন্ন সময় ভূয়া বিল ভাউচারে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করতেন। দীর্ঘদিন কলেজ পরিচালনায় তিনি নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার করে আসছেন।
এসব বিষয়ে সাম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী, সচিব ও জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। তাই কলেজে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য অধ্যক্ষের অপসারণের দাবি করছেন শিক্ষকরাও।
কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক শাহনূর আক্তার বলেন, ‘আমার ক্লাস ছিল। কিন্তু সকালে কলেজের এসে দেখি শিক্ষার্থীরা সবাই আন্দোলন করছে। তারপর ওই নোটিশের বিষয়ে জানতে পারি। তবে অধ্যক্ষ স্যার ওই ব্যবস্থাগ্রহন বা অভিযোগের বিষয়ে আমাদের শিক্ষকদের সাথে কোন আলোচনা করেন নি।
শিক্ষক আসাদুজ্জামান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘সকালে কলেজের এসে দেখি আমাকে একটা কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বানোয়াট। আমার ছাত্রীরা এখানে আছেন। তাদের কাছ থেকে শুনেন। নিজের অপকর্ম ঢাকতে অধ্যক্ষ ওই মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন।’
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যক্ষ ড. এস এম রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি কলেজের ছাত্রী ও অবিভাবকদের কাছ থেকে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের অভিযোগ পেয়ে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেই। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের যথাযথ কারন দর্শাতে বলেছি। এই কারন দর্শানোর নোটিশ পেয়ে ওই শিক্ষক কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়ে আমার বিরুদ্ধে উষ্কাচ্ছে।’
তিনি দাবি করেন, কলেজে ‘সিক বেডে’র নামে আগে বিভিন্ন পরীক্ষার সময় কিছু ছাত্রকে অনৈতিক সুবিধা দিতেন কয়েকজন শিক্ষক। তাঁরা সেখান থেকে লাভবান হতেন। তিনি ওই অনৈতিক সুবিধা বন্ধ করেছেন। ফলে যে শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তারা ওই সব করছেন। বলেন, ‘আমি কলেজের উন্নয়নে অবদান রেখেছি। এখানে মেয়েদের জন্য অনার্স ও ডিগ্রী কোর্স চালু করেছি। সব মিথ্যা ও ভূয়া অভিযোগে ওই আন্দোলন করা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে জানা ছিলনা। তবে কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের বেশি কিছু অভিযোগ পেয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেডের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। দ্রুতই ওই কিমিটি প্রতিবেদন দিবে। প্রতিবেদন পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে আমরা বিষয়টি তুলে ধরে দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।