নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগে বাগেরহাটের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মান্নান তালুকদারসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) দুদকের খুলনা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. শাওন মিয়া বাগেরহাট সদর মডেল থানায় মামলাটি করেন।
মামলার আরেক আসামি নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান। তিনি বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুরপাড় জামে মসজিদের ইমাম।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান না হয়েও পুঁজি সংগ্রহের নামে গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুর পাড়সংলগ্ন সরুই ছোট কবরখানা মোড়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়।
প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রায় এক দশক ধরে বাগেরহাট ছাড়াও খুলনা, পিরোজপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকদের কাছ থেকে মাঠকর্মীর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে।
বাগেরহাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহাতাব উদ্দীন বলেন, ‘দুদকের (খুলনা) জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. শাওন মিয়া বৃহস্পতিবার মামলাটি করেন। আমরা এজাহার হিসেবে মামলাটি নথিভুক্ত করেছি। দুদকই মামলার তদন্ত করবে।’
মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শাওন মিয়া বলেন, ২০১৮ সালের শেষ দিকে বাগেরহাটের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে দুদক অনুসন্ধানে নামে। অনুসন্ধানে নেমে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে নানা অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা মেলে। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনের কাছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত ও মামলা করার অনুমতি চাওয়া হয়।
কমিশন অনুমতি দেওয়ায় মামলাটি করা হয়েছে। ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২), ৪(৩) ও ৪(৪) ধারায় বাগেরহাট সদর মডেল থানায় নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান তালুকদার ও তাঁর সহযোগী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে ১১০ কোটি ৩১ লাখ ৯ হাজার ১৩৫ টাকা ৫৮ পয়সা অবৈধ সম্পদ অর্জন, অপরাধলব্ধ আয় স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের অভিযোগের মামলা করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ১০ কোটি টাকা। কোম্পানির মোট ১০০০ শেয়ারের মধ্যে আবদুল মান্নান তালুকদারের ৮৫০টি, চেয়ারম্যান আনিসুর রহমানের ৫০টি, তাঁর মা সালেহা বেগম ও স্ত্রী জেসমিন নাহার ৫০টি করে শেয়ারের মালিক। প্রকৃতপক্ষে নিউ বসুন্ধরার চেয়ারম্যান হিসেবে মো. আনিসুর রহমানের নাম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মান্নান তালুকদার।
দুদকের খুলনা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক (ডিডি) নাজমুল হাসান বলেন, ২০১০ সালে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (এমএলএসএস) আবদুল মান্নান তালুকদার স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি জমি কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার পর তিনি গ্রাহকদের প্রতি লাখে মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রলোভনে বাগেরহাট, খুলনাসহ বেশ কয়েকটি জেলার অন্তত ২০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত ২৯৯ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেন, যা ব্যাংকিং আইনের পরিপন্থী।
গত কয়েক বছরে বাগেরহাটের ১৬টি ব্যাংকের ৩০টি (অ্যাকাউন্ট) হিসাবে ১১০ কোটি ৩১ লাখ ৯১৩৫ টাকা ৫৮ পয়সা জমা করেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি ব্যাংক থেকে তুলে পাচার করেছেন। এই টাকা কোথায় পাচার করা হয়েছে, তা জানতে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে। দুদকের প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাগেরহাটের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান তালুকদার ও তাঁর চেয়ারম্যান আনিসুর রহমানকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে দুদক।
বাগেরহাটসহ এই অঞ্চলের হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা তুলে এখন প্রায় লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটির প্রধানসহ কর্মকর্তারা। ফলে লাভের আশায় এখানে টাকা জমা গ্রাহকেরা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে তাঁরা কোনো টাকা পাচ্ছেন না।
বাগেরহাট সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি চার বছর আগে চাকরি থেকে অবসরে যাই। অবসরে যাওয়ার পর আমার চাকরির জীবনে অর্জিত ২০ লাখ টাকা নিউ বসুন্ধরা লিমিটেডে জমা রাখি। নিউ বসুন্ধরা আমাকে প্রতি লাখে মাসে দুই হাজার টাকা করে লভ্যাংশ দিয়ে আসছিল। গত প্রায় দশ মাস ধরে ওই প্রতিষ্ঠানটি আমাকে কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। আমি এখন লভ্যাংশ ছেড়ে আমার মূলধন ফেরত চেয়ে পাচ্ছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিউ বসুন্ধরা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মান্নান তালুকদার খুবই চতুর প্রকৃতির মানুষ। তিনি মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর মনোনীত লোকদের কাজে লাগিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার এই ফাঁদে পড়ে হাজার হাজার গ্রাহক আজ সর্বস্বান্ত। আমার মতো যাঁরা তার এই ফাঁদে পা দিয়েছেন, তাঁরা আদৌ তাঁদের মূলধন ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মান্নান তালুকদারের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এজি//এসআই/বিআই/৩০ মে, ২০১৯