কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
খুন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, দখল—সবকিছুই ডালভাত তাঁর কাছে। আশির দশক থেকেই শুরু। বলা চলে সব সময়ই তিনি সরকারি দলের লোক। ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় দিনে দিনে গড়েছেন অপ্রতিরোধ্য ত্রাসের রাজত্ব। বনেছেন সম্পদের মালিক। আবার প্রশাসন আর নেতাদেরও হাতে রেখেছেন যখন যাকে প্রয়োজন। ক্ষমতার একচ্ছত্র দাপটে সব অপকর্মেই পার পেয়েছেন। নানা আশীর্বাদে থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তিনি শহীদুল ইসলাম ফকির, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।
নানা অপকর্মে জড়িত থেকেও সবশেষ ইউপি নির্বাচনে (২০১৬) আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে হয়েছেন জনপ্রতিনিধি। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার, তবু রেহাই পায়নি দলের স্থানীয় নেতারাও।
শহীদুল ফকির ১ অক্টোবর দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ দলের দুই নেতাকে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনার মূল হোতা। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তাকে। গতকাল মঙ্গলবার (২ অক্টোবর) তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী দিহিদার ও সাবেক যুবলীগ নেতা শেখ শুকুরকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে-পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যার পর ব্যপক আলোচনায় আসেন ইউপি চেয়ারম্যান শহীদুল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় পর পর দু’বার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। নিজের ইউপি কার্যালয়কে ‘টর্চার সেলে’ পরিণত করেছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করলে বা বিরুদ্ধে কথা বললে শহীদুল ফকির ও তার সন্ত্রাসী সহযোগীরা অস্ত্রের মুখে ধরে এনে চালাতো অমানবিক নির্যাতন। এলাকায় তার এমন অন্তত ৩টি টর্চার সেল ছিল।
গেল সোমবার শত শত মানুষের সামনে প্রথমে স্থানীয় সেলিমাবাদ কলেজ মাঠে এবং পরে ইউপি কার্যালয়ের ফেলে কুপিয়ে, পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেন দুজনকে। ঐ ঘটনায় গুরুতর আহত দৈবজ্ঞহাটী ইউনিয়ন তাঁতীলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক বাবুল শেখ (৪২) ও নিহত আনসার আলীর স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৪৫)। তারা খুলনা ও ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ঘটনার চারদিন পর বৃহস্পতিবার রাতে থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। যার প্রধান আসামি শহীদুল ফকির।
শহীদুল দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়নের আলতিবুরুজবাড়িয়া গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে। স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত বাগেরহাট-৪ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মো. মোজাম্মেল হোসেনের আস্থাভাজন হিসেবে।
তবে, প্রায় ৬ মাস ধরে এমপি ডা. মোজ্জাম্মেলের সাথেও তার সম্পর্ক তেমন ভালো নেই বলে দাবি করেছেন দলে তার সমর্থক কয়েক নেতা। অন্যদিকে এ ঘটনায় নিহত ও আহতরা মনোনয়ন প্রত্যাশি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এইচ.এম বদিউজ্জামান সোহাগের কাছে মানুষ বলে পরিচিত। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জোড়া খুনের ওই ঘটনায় স্থানীয় রাজনীতিতে নানা প্রভাব ফেলছে। মঙ্গলবার বিকালে নিহতদের জানাযার অংশ নিতে গিয়ে লাঞ্চিত হন ডা. মোজাম্মেল। এতে ওই দুই মনোনয়ন প্রত্যাশীকেই ক্ষতিগ্রস্ত। সব মিলে এই ঘটনা ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’র মতো মনোনয়ন প্রত্যাশি তৃতীয় কোন নেতা কি এই খুনের নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন কিনা তাই এখন আলোচনা বিষয়। আবার এমনও হতবে পারে পথের কাটা দূরকরতে বা মাদকের কোন ঘটনা এই হত্যার নেপথ্য।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় বলেন, দুই আওয়ামী লীগ নেতা হত্যা মামলার প্রধান আসামী শহীদুল ফকিরসহ তার কয়েক সহযোগীকে গ্রপ্তার করা হয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এক শহিদুল ফকিরের উত্থানের নেপথ্যে
স্থানীয়রা বলছেন, আশির দশকে শহীদুলের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু বাকশাল ছাত্রলীগের হাত ধরে। এ সময়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাকশাল ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ্যাড. আমিরুল আলম মিলনের সাথে। পরবর্তিতে তিনি জাতীয় যুব সংহতিতে যোগ দেন এবং এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ, বিএনপি হয়ে আবার আওয়ামী লীগের ছাতার নীচে আশ্রয় নেন।
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শহিদুল ফকির বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনে কাস্তে প্রতিকের সংসদ সদস্য প্রার্থী আমিরুল আলম মিলনের পক্ষে দলবল নিয়ে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালান। ঐ নির্বাচনে আমিরুল আলম মিলন জয়ী না হলেও আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহযোগী সাবেক মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজকে পরাজিত করে জামায়াত ইসলামের প্রার্থী।
১৯৯১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি। শহিদুল ফকির তখন স্থানীয় বাগেরহাট-৪ আসনের তৎকালিন জামায়াত দলীয় এমপি মুফতি মাওলানা আব্দুস সাত্তারের প্রধান সেনাপতি হয়ে যান। এমপি সাত্তার তাকে একটি মাইক্রোবাস কিনে দেন। ঐ মাইক্রোবাসে দলবল নিয়ে তিনি মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতন চালায় সেই সময়। এমনকি তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি’র নেতাকর্মীরাও শহিদুল ফকিরের হাত থেকে রক্ষা পাননি। ঘের দখল, জমি দখল ,হত্যাসহ নানা অপকর্মে জড়ায়। শহিদুল ফকির তৎকালীন মোরেলগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নেতা আব্দুর মান্নান খানের পায়ের রগ কেটে দেয়।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন তৎকালীন এমপি ডা. মোজ্জামেলের পক্ষে পাল্টিখায় এই শহীদুর। ডা. মোজ্জামেলের সাথে তখন বিএনপি নেতা মনা খাঁসহ কয়েক জনের বিরোধ ছিল। বিরোধ ছিল শহীদুলের সাথেও। মনা খাঁ হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ায়। তখন বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে ওই জগতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়।
২০০১ সালে বিএনপির সাথে জোট হয় জামায়াতের। জোট সরকারের আমলে তখন আবার এমপি হন জামায়াতের মুফতি আব্দুস সাত্তার। শহিদুল ফকির ফের দল বদল নিয়ে তার সাথে যোগ দেয়। এসময় তিনি বনে যায় যুবদল নেতা। দৈবজ্ঞহাটী ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতির পদটি বাগিয়ে নিয়ে এলাকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতাকর্মীসহ সাধারন মানুষের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করেন। সে সময় বাগেরহাট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি, ইউপি চেয়াম্যান আব্দুর রশিদ খা হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন। মারধর, লুট দখল ছাড়াও সে সময় বেশ হত্যাকাণ্ডে নাম আসে তার।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ থেকেই শহীদুর ডাক্তার মোজাম্মেলের পক্ষে কাজ শুরু করেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে শহিদুল ফকির ভোল পাল্টে এবার আওয়ামী লীগের ছাতার নীচে আশ্রয় নেন। বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বাগেরহাট -৪ আসনের এমপি ডা. মোজ্জাম্মেল হোসেনের কাছের লোক হয়ে যান তিনি। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ডা. মোজাম্মেল হোসেন শহীদুল ফকিরকে দৈবজ্ঞহাটি ইউপি চেয়ারম্যান হতে সহযোগিতা করেন। তখনও তিনি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. মোজাম্মেল হোসেনকে তিব্র প্রতিদ্বন্দিতায় ফেলে দেন দলের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী তৎকালিন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম খান ও মোরেলগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পৌর মেয়র মনিরুল হক তালুকদার। এ সময় শহীদুল ফকির দলবল নিয়ে এলাকায় ডা. মোজাম্মেলের পক্ষে কাজ করেন এবং তাকে বিজয়ী করেন। এর পুরস্কার হিসেবে ২০১৬ সালে নৌকা প্রতিক নিয়ে ইউপি নির্বাচনে বিজয়ী হয় শহীদুল। এরআগে অবশ্য যুবদল থেকে আনুষ্ঠনীক ভাবে পদত্যাগ করে তিনি। হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা। হয়ে ওঠেন আরো আরো বেপরোয়া। মাদক ব্যবসায়ও তার আধিপত্য বাড়ে।
তবে, ডা. মোজাম্মেলের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলছেন, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিত্যাগ না করায় প্রায় ৬ মাস ধরে এমপি ডা. মোজ্জাম্মেল হেসেনের কাছে সে ভিড়তে পারতো না। তাই অন্য কোন নেতার আশ্রয় খুঁজছিলেন তিনি। তবে বিষয়টি দলীয় সূত্র থেকে সম্পূর্ণ পরিস্কার হওয়া যায়নি।
বর্তমান সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগে কোন পদে না থেকেও দৈবজ্ঞহাটীসহ মোরেলগঞ্জ -শরণখোলা এলাকায় তিনি প্রভাবশালী ব্যাক্তি হয়ে ওঠেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর শহিদুর ফকির ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের মাছের ঘের, জায়গা জমি দখল, চাঁদাবাজি শুরু করেন। এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। তার নের্তৃত্ব মেনে না নেয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন তার নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তিনি ইউপি কার্যালয়, নিজের চিংড়ি ঘেরসহ এলাকায় চারটি টর্চার সেল তৈরী করেন।
চেয়ারম্যান শহিদুল ফকির ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা হারেজ আলী শেখকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে পায়ের রগ কেটে দেয়। বলাইবুনিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারন সম্পাদক জাহাংগীর, আলতি-বুরুজবাড়িয়া গ্রামের রোমান হাওলাদার, তেলিগাতি ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর, একই ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতি রনি খান ও শ্রমিকলীগের সভাপতি মো. আছাদকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন।
সবশেষ ইউপি নিরর্বাচনের আগে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হত্যাসহ ৬৭টি মামলা হওয়া কথা উল্লেখ করে এলাকায় পোস্টারিংও হয়। তবে নানা উপায় অধিকংশ মামলা থেকে তিনি অব্যহতি নিয়েছেন। গেল প্রায় ৩০ বছর ধরে মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা এলাকায় তার বিরুদ্ধে হওয়া অর্ধশতাধীক মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পকে জানা সম্ভব হয়নি।
আহসান/এসএইচ//এসআই/বিআই/০৪ অক্টোবর, ২০১৮
** দলীয় বিরোধই খুন হন ২ আ.লীগ নেতা, গুলি করা হয় প্রকাশ্যে
** জানাযায় এমপিকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ
** কোন্দলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ নিহত ২