স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
পয়লা বৈশাখ আর হালখাতা যেন বাঙালি সংস্কৃতিতে অনেকটা যমজ ভাইবোনের মতো। বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে হাত ধরাধরি করে হাজির হতো এই দুই উৎসব।
১৫৮৪ সালে ১০-১১ মার্চ সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, সেটাই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত।
অতীতে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে ‘হালখাতা’ বা ‘পুণ্যাহ’ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারী প্রথা উঠে যাওয়ায় পুণ্যাহ বিলুপ্ত হয়। কিন্তু হালখাতা অক্ষুণ্ণ থাকে ব্যবসায়ীদের পালনে।
চিরাচরিত এই উৎসব আর ঐতিহ্যকে ধারণ করে বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার ভূমি অফিসে শুরু হয়েছে ব্যতিক্রমি ‘ভূমি-হালখাতা’।
বলা হয়, হালখাতা অনুষ্ঠান থেকেই শুরু হয় পহেলা বৈশাখ উদযাপন। মুঘল সম্রাট আকবর কৃষি ফসলের সাথে মিল রেখে বাংলা সন প্রবর্তনের পর তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকলের খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে জমিদাররা নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের আপ্যায়ন করতেন।
ঐতিহ্যবাহী সেই হালখাতার আদলে ভূমি উন্নয়ন কার ও অন্যান্য ভূমি রাজস্ব আদয়ে ভূমি-হালখাতা পালনের এই আয়োজন করেছেন মোল্লাহাটের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহবুবুল আলমের।
পথে পথে করা হয় আল্পনা। বৈশাখী সাজ। হালখাতা উপলক্ষে অফিস চত্বর সাজানো হয় বর্ণিল সাজে।
প্রথম বারের মত ভূমি অফিসে এমন হালখানা পাললে এসেছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, বিভিন্ন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ সাধারণ মানুষ। অনুষ্ঠানে আগতদের দেশি ফল, বাতাসা, কদমা, মুরলি দিয়ে আপ্যান করা হয়।
মোল্লাহাটের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহবুবুল আলম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, জনগনের জন্য সেবা প্রাপ্তি সহজ করতে বেতিক্রমী কিছু করার ভাবনা থেকে হালখাতা করার চিন্তা আসে। আমার চেষ্টা ছিল ঐতিহ্যকে লালন করে কিভাবে সেবা প্রদান ও রাজস্ব আদায় সহজ করা যায়।
সরকারি ছুটির দিনেও অফিসে এসে সবাই কাজ করছেন। সাধারণ জনগনের কাজ থেকেও খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। ভূমি অফিস নিয়ে অনেকের মাঝেই একটি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। সেবা পেতে হয়রানি, দাললের কথা সবাই বলে। আমি এই ধারণা ভাঙতে চেয়েছি। আর এই কাজে অফিসের সহকর্মীসহ সবার সহযোগীতা পেয়েছি।
তিনি বলেন, ‘আমরা ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়ে উন্নয়ন করতে চাইনা। ঐতিহ্যকে বুকে ধারন করে সবাই মিলে যদি উন্নয়নের পথে হাটতে চাই। কেবল আমার অফিসে নয়, উপজেলার তিনটি ভূমি অফিসে ১-৭ বৈশাখ এই ভূমি-হালখাতা চলবে।’
বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে উৎসব মুখর পরিবেশে অনেকেই এসেছিলেন হালখাতায় অংশ নিতে। বাৎসরিক খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) পরিশোধে। খাজনা দিতে এসেছিলেন স্থানীয় উদয়পুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শেখ হায়দার মামুন।
তিনি বলেন, এভাবে কখনও খাজনা দেই নি। ভূমি অফিসে আপায়ন। হালখাতায় এসে বছরের প্রথম দিনেই আমি জমির সব খানজা দিতে পেরে আনন্দিত।
এদিন ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে আব্দুল আলিম মোল্লা বলেন, এতো সুন্দর পরিবেশে খাজনা দিতে পেরে ভালো লাগছে। এখনও হালখাতা খুব এটা হয় না। আমি আমার ছেলে মেয়ে দেরও নিয়ে আসছি। খুব ভালো লাগছে। সরকারি অফিসে দ্রুতই কাজ হয়েছে। আবার তারা আপ্যায়নও করলো।
রাজস্ব আদায়ে এমন উদ্যাগ অনুকরনীয় বলেছেন স্থানীয়রা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন আল ফারুক বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, হালখাতা আমাদের সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই উদ্যোগটাকেই নতুন ভাবে নিয়ে আসা হয়েছে।
‘কোন জমি ভোগ দখল করতে দলিল, দখল ও দাখিলা আবশ্যক। আমি মনে করি ভূমি-হালখাতা পালনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভূমি উন্নয়ন কর সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে। একই সাথে ঐতিহ্যকে ধারণ করে এ ধরনের কার্যক্রম সরকারের রাজস্ব আদায়ে সাফল্য আনবে।’
মোল্লাহাট উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শাহিনুল আলম ছানা বলেন, এখানকার ভূমি সহকারী কমিশনার নিজ উদ্যোগে এই আয়োজন করেছেন। আমাদের হালখাতার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনে তার এই উদ্যোগ সবাইকে স্বপ্রনদিত হয়ে কর প্রদানে উৎসাহী করবে।
‘আমি আশা করি প্রতিবছর এই উদ্যোগ নেওয়া হলে খুব ভালো হবে। পাশাপাশি এমন উদ্যোগ সারাদেশে ছড়িয়ে দিলে সরকারে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।’
এইচ//এসআই/বিআই/১৪ এপ্রিল ২০১৮