স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
`দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডে’র বিরুদ্ধে বাগেরহাটের পাঁচশতাধিক গ্রাহকের অন্তত ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
বেসরকারি ওই অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও গ্রাহকের জমা রাখা টাকা ফেরৎ দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। উল্টো গ্রাহকদের নানা ধরণের হুমকি দিচ্ছে বলে শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে বাগেরহাট প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকেরা অভিযোগ করেন।
জানা গেছে, ২০১২ সালে বাগেরহাট শহরের সাধনার মোড়ে সফি মার্কেটের তৃতীয় তলা ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই ব্যাংক নামটি ব্যবহার করছিল ‘দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড’ নমের প্রতিষ্ঠানটি।
তবে, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে ওই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে কোন তথ্য নেই।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন চৌধুরীর বাড়ি পিরোজপুর জেলার শিকারপুর গ্রামে। ১৯৬৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি সমবায় থেকে নিবন্ধন পায়। (নিবন্ধন নং ৭১০) বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠানটির ৩৪টি শাখা রয়েছে বলে তাদের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে।
মুনাফার আশায় ওই প্রতিষ্ঠানে অর্থ আমানত রাখা ৩৫ জন গ্রাহক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে, মুনাফা তো দূরের কথা, প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাছে জমা রাখা গ্রাহকদের আমানতের টাকাই এখন ফেরত দিচ্ছেনা।
প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ শতাধিক গ্রাহকের মধ্যে ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা রয়েছেন। এরমধ্যে এফডিআর গ্রাহকের সংখ্যাই ১১৫ জন। যারা ৫০ হাজার টাকা থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত টাকা জমা রেখেছিলেন।
তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক ওই টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছে তাই তাদের কিছুই করার নেই বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাগেরহাট শহরের পত্রিকা ব্যবসায়ী ও ওই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক মোকাদ্দেস আলী।
তিনি লিখিত অভিযোগে বলেন, দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড উচ্চ হারে মুনাফা প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা সঞ্চয়ের (এফডিআর, ডিপিএস) নামে প্রলুব্দ করে বাগেরহাটের বিভিন্ন পেশার মানুষদের মাঝে প্রচারণা চালায়। তারা তিন বছর মেয়াদী ফিক্সড ডিপোজিটে লাখে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
তাদের পাতা ফাঁদে পা দেয় কয়েকশ গ্রাহক। তারা ওই প্রতিষ্ঠানটির কাছে জমা রাখা টাকা ফেরৎ চাইতে শুরু করলে তৎকালীন ব্যবস্থাপক নিহার রঞ্জন হালদার এলাকা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, বাসুদেব দে নামে এক গ্রাহক ওই প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন ব্যবস্থাপক নিহার রঞ্জনকে ভারত থেকে ধরে এনে বাগেরহাট জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সোপর্দ করলেও তারা তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়েই ছেড়ে দেয়।
সংবাদ সম্মেলনে মোকাদ্দেস আলী আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন চৌধুরী সাম্প্রতি স্বাধীন শেখ নামে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারিকে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দিয়েছেন। শহরের সাধনার মোড় এলাকা থেকে অফিস সরিয়ে বর্তমানে দশানী এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে বসে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। তবে এখনও তাদের পাওনা পরিশোধ করছেন না।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বাসুদেব দে বলেন, গ্রাহকরা তাদের পাওনা টাকা ফেরৎ চাইতে গেলে বর্তমানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন আগের ব্যবস্থাপক টাকা আত্মসাত করে চলে গেছেন। তাই আমরা তোমাদের কোন টাকা ফেরৎ দিতে পারব না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এই নিয়ে মামলা বা বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।
মোকাদ্দেস আলী বলেন, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি প্রথমে এক লাখ টাকা জমা রাখি। এর দুই মাস পর আরও দুই লাখ নিয়ে মোট তিন লাখ টাকা জমা রাখি। এরপর এক বারই আমি (চার মাসে) মোট ২৪ হাজার টাকা লভ্যাংশ পাই। আমার দেখা দেখি অনেকেই এখানে তাদের টাকা এখানে জমা রাখেন। আমরা কয়েকশ গ্রাহক মুলধন হারিয়ে এখন সর্বশান্ত। প্রশাসনের কাছে যেয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছিনা।
ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহক অনিমা রায় বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আবার বাবা বাগেরহাটের কাড়াপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সুনিল কৃষ্ণ রায়। পেনশনের পর তিনি তার সঞ্চিত ৮ লাখ টাকা মুনাফার আশায় ওই ব্যাংকে জামা রাখেন। এখন কোন টাকাই ফেরত পাচ্ছেন না।
অনিমা রায় এবং তার ভাইয়ের স্ত্রী চান্দনা রানীও ওই প্রতিষ্ঠানে কয়েকটি হিসাবে ৮ লাখ ২৩ হাজার ও ৩ লাখ টাকা জামা রাখেন। অন্য গ্রাহকদের মতো তারাও কোন টাকা না পেয়ে সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
বাগেরহাট সদর উপজেলার পশ্চিম ডাঙ্গা গ্রামের হাসিব হাওলাদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ২০১৬ সালে দুই দফায় ছয় লাখ জমা করি। এরপর আমার দেখাদেখি বোন শাহীনুর বেগমও তিন লাখ টাকা জমা দেয়। প্রথম ছয় মাস আমি মাসে লাখে দুই হাজার করে মুনাফা (লভ্যাংশ) পাই। কিছুদিন পরেই তারা টাকা দিতে টালবাহানা শুরু করলে আমি আমার জমা রাখা টাকা ফেরৎ চাই।
তাদের প্রলোভনে পড়ে আমরা শতশত গ্রাহক কয়েক কোটি টাকা তাদের দিয়ে আমরা এখন সর্বশান্ত হয়ে পড়েছি। এই টাকা ফেরৎ পেতে চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর আমি বাগেরহাটের অতিরিক্ত মূখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে একটি মামলা করি। মামলাটি বিচারক আমলে নিয়ে তা তদন্ত করতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে দায়িত্ব দেয়। পুলিশ এখনো তাদের তদন্ত শেষ করতে পারেনি বলে অভিযোগ তার।
এ প্রসঙ্গে জানতে দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন চৌধুরীর (০১৭৬৪৬৮৮৪৮৪) নাম্বারে যোগাযোগ করলে এক নারী নাম্বারটি রিসিভ করে রং নাম্বার বলে লাইনটি কেটে দেন।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় বলেন, অর্থ লগ্নিকারী কোন প্রতিষ্ঠান তার বৈধ অনুমতি নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আামার কিছু জানা নেই। তবে ক্ষতিগ্রস্থরা আমার কাছে আসলে আমি তাদের আইনী সহযোগিতা করব।
বাগেরহাটের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান বিকালে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, কোন অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। তাছাড়া তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এই প্রতিষ্ঠানটির কি অনুমতি আছে বা বাগেরহাটে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা অবহিত নই।
হুমকি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের বাগেরহাট শাখা ব্যবস্থাপক মো. স্বাধীন বিকালে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা তৎকালিন ব্যবস্থাপক নিহার রঞ্জন হালদার প্রায় তিন শতাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন। তবে তা আমাদের এখানে জমা না করে নিজে আত্মসাত করেছেন। তিনি ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকার কোন হিসাব দেখাতে পারেননি।
ভারতে পালিয়ে যাবার পর একবার তাকে ধরে আনা হলেও তিনি গত আগষ্টে আবার পালিয়ে যান। এরপর থেকে তিনি লাপাত্তা। চলতি বছরের ২৯ মার্চ বাগেরহাটের প্রতারিত গ্রাহকরা তাদের মূলধন ফেরৎ পেতে আমাকে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে বসিয়েছেন। আমি ইতিমধ্যে ২১৫ জন গ্রাহককে অন্তত ১৫ লাখ টাকা ফেরৎ দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে অন্যদের টাকাও ফেরৎ পাইয়ে দিতে কাজ করছি।
এজি//এসআই/বিআই/২৪ নভেম্বর, ২০১৭