বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের
৭০ বছর পূর্তি ও পুনর্মিলনী উৎসব
সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
সকাল হতেই সবাই হাজির, একই পোশাক; মাথায় ক্যাপ। সেই পুরনো নিয়মে লাইনে দাঁড়ালেন প্রত্যেকে। হলো জাতীয় সঙ্গিত, শপথ পাঠ। ঠিক যেন ক্লাস শুরুর আগেকার সেই অ্যাসেম্বলি।
দীর্ঘদিন পরে এই অ্যাসেম্বলিতে অংশ নেওয়াদের কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তার, জাতীয় সংসদের আইন প্রণেতা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী। তবে সব পরিচয়ই যেন ক্ষুদ্র এখানে। কারণ সবার পরিচয়ই যে একটা; বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র।
প্রিয় বিদ্যালয়ের ৭০ বছর (১৯৪৭-২০১৭) পূর্তি উপলক্ষ্যে সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) শুরু হওয়া প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠেনে এসেছিলেন সবাই। তাই তো চারদিকে ছিল উৎসবের আবহ; ক্যামেরার ক্লিক, ক্লিক শব্দ।
সেখানে কেউ ব্যস্ত বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ছবি তুলতে তো কেউ ব্যস্ত ‘সেলফি’ তোলায়। স্কুল জীবনের প্রাণের সতীর্থদের স্মৃতির অ্যালবামে রাখতেই এ ছবি তোলার হিড়িক।
সকালে প্রাক্তন ছাত্রদের সমাবেশ, জাতীয় সংগীত ও শপথ পাঠ শেষে বের হয় বাইসাইকেল র্যালি ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। বিদ্যালয়ের নবীন-প্রাবীন, বর্তমান- প্রাক্তন মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাত্র অংশ নেন এই শোভাযাত্রায়।
‘প্রাণের মাঝে আয়’ স্লোগানে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ১৯৪৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ব্যানার, প্লাকাট আর রং বেরঙের মুখোশ ও নানা ধরণের প্রতিকৃতি সহকারে অংশ নেন শোভাযাত্রায়। সহস্রা নবীন-প্রবীনের অংগ্রহণে শোভাযাত্রাটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। উৎসবের আবহ ছড়ায় গোটা শহর জুড়ে।
শোভাযাত্রা শেষে স্কুল মাঠে মূল মঞ্চে সম্মিলিত ভাবে পুর্নমিলনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বাগেরহাটের তিন এমপি ডা. মোজাম্মেল হোসেন, মীর শওকাত আলী বাদশা, তালুকদার আব্দুল খালেক, বিদ্যালয়ের পাক্তন ছাত্র এবং শিক্ষা মন্ত্রনারয়ের অতিরিক্ত সচিব ডা. মোল্লা জালাল উদ্দিন ও খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুস সামাদ।
পরে প্রাক্তন ছাত্র পুনর্মিলনী ২০১৭ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যপক মোজাফ্ফর হোসেনর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা, সম্মাননা প্রদান ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও অতিথিরা।
এসময়ে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন- যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীম, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রাক্তন ছাত্র নকিব নজিবুল হক।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবাই মেতে ওঠেন আনন্দ-আড্ডায়। দীর্ঘ্যদিন পর প্রিয় বিদ্যালয়ে সবাই যেন তরুণ। ফিরে যান স্কুল জীবনে স্মৃতীতে।
১৯৯৭ এর ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্র ও বাগেরহাট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. প্রদীপ কুমার বকসী বলেন, আমরা চার ভাই’ই এই বিদ্যালয়ের ছাত্র। আজ এক সাথে সবাই স্কুলে এসেছি। অনেক দিন পর পুরন ক্যাম্পাসে। অনেক স্মৃতিবিজড়িত, ভালোলাগার মুহূর্ত এই জায়গাটায়। বলতে গেলে সবাই ভালোলাগার। আর কষ্টটা হলো স্কুল জীবন শেষ হয়ে গেলো। কর্মজীবনে না এসে যদি স্কুল জীবনে থাকতাম তা হলে ভালো থাকতাম।
আমাদের স্কুলের অনেক ছাত্র এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় আছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা সবাই আজ এক সাথে এসেছেন। নিঃস্বন্দেহে অনেক ভালো লাগছে।
সোমবার দুপুরের খাবারের পর বিকালে প্রাক্তন ছাত্রদের আড্ডা ও ক্রিড়ানুষ্ঠান এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক অনুষ্ঠিত হয়।
পুনর্মিলনী আয়োজক কমিটির প্রধন সমন্বয়ক শেখ মুজিবুর রহমান জানান, বাগেরহাট সরকরি উচ্চ বিদ্যালয়ের গৌরবময় ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যাচের ১৮শ’ এর অধিক শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। পাশাপাশি বর্তমান ১৭শ’ শিক্ষার্থীও আয়োজনের অংশ হয়েছে।
তিনি বলেন, পুনর্মিলনী উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, বিকালে আড্ডা ও স্মৃতিচারণ এবং সন্ধ্যায় আতশবাজী ও ওপেন এয়ার কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। দেশের খ্যাতনামা ব্যন্ড এলআরবি-আইয়ুব বাচ্চু ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পীরা ওই অনুষ্ঠানে সঙ্গিত পরিবেশন করবেন।
এছাড়া পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে অংশ হিসেবে একটি বিশেষ র্যাফেল ড্র এর আয়োজন করা হয়েছে। যেখান থেকে সংগৃহীত অর্থের একটি অংশ দেশের বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের সাহয্যে প্রদান করা হবে বলে জানায় আয়োজক কমিটি।
বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়:
বিংশ শতাব্দির ২য় দশকের শেষ ভাগে সমগ্র ভারতবর্ষে শিক্ষা সংস্কারে নবজাগরণ প্রবাহিত হতে শুরু করে। এরই ফলশ্রতিতে ১৯২৯ সালে বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব মরহুম আলহাজ্ব ডাঃ মোজাম্মেল হোসেনের প্রচেষ্টায় ‘একটি মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বাগেরহাট জুনিয়র মাদ্রাসা’ নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অল্প দিনের মধ্যেই বাগেরহাটের শিক্ষা ক্ষেত্রে আলোক বর্তিকায় রুপান্তরিত হয়।
পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সহযোগীতায় মরহুম ডাঃ মোজাম্মেল হোসেনের নের্তৃত্বে মাদ্রাসাটিতে একটি পূর্নাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তখন নামকরণ করা হয় ‘বাগেরহাট মুসলিম হাই স্কুল’।
৪৭-এ প্রতিষ্ঠালগ্নের সময়ে থেকে সুদীর্ঘ ১৫ বছর বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন কুষ্টিয়া নিবাসী মোকাদ্দেস হোসেন।
১৯৫১ সালে বাগেরহাটে আসেন তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন। সে সময়ে তিনি বিদ্যালয়ের জন্য এককালিন ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। সেই সুবাদে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় ‘নুরুল আমীন হাই স্কুল’।
১৯৬১ সালের ১ আগস্ট জাতীয়করণ করা হয় নুরুল আমীন হাই স্কুলকে। তখন বিদ্যালয়টিতে খোলা হয় বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ও কৃষি বিভাগ।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় ‘বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’। বর্তমানে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাতি ও দিবা নামে দুটি শিফটের মোট ৩২টি শাখায় ৩য় শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৭শ’ ছাত্র অধ্যয়নরত বলে জানান প্রধান শিক্ষক সেখ আকরাম হোসেন।
তিনি বলেন, এই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান বিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রদেরও অনুপ্রাণিত করবে। এখানকার ছাত্ররা এখন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চ আসনে আছে। এখনকার ছাত্ররা এ থেকে আরও উজ্জিবিত হবে।
‘আশাকরি আগামীতে শতবর্ষ উৎযাপন ও পুনর্মিলনী হবে এই বিদ্যালয়ে। তখন হয়ত আমি থাকবো না। তবে এখনকার ছাত্ররাই তখন বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবে এটই আশাবাদ।’
এইচ//এসআই/বিআই/০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭