স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি মাঝে দিগন্তজোড়া মাঠ। সৃষ্টিতে প্রজ্ঞা-জ্ঞানের মহামিলন। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের সমৃদ্ধ গৌরবউজ্জল স্মৃতি। সব মিলে বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের আজ পূর্ণতা।
শত বছরে পা রাখছে বাগেরহাটর কলেজটি। তবে এ উপলক্ষে বড় ধরনের কোনো আয়োজন নেই।
১৯১৮ সালের ৯ আগস্ট বাগেরহাট শহরের হরিণখানা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের স্বীকৃতি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন এর নাম ছিল ‘বাগেরহাট কলেজ’।
বাঙালি তথা ভারতের বিজ্ঞান ভাবনার অগ্রদূত বিশ্ববরেণ্য পদার্থ বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) রায় তৎকালীন হাবেলী পরগনার জমিদার, সাধারণ মানুষ ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের নিয়ে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ১৯১৬ থেকে শুরু বাগেরহাট কলেজ প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রা।
পিসি রায়ের অনুরোধে কলেজের প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঋষি কামাখ্যা চরণ নাগ। তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করতে পারতেন। প্রায় ২২ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯২৪ সাল পর্যন্ত কলেজটিতে ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস ও সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হতো। পরবর্তী সময়ে বাংলা, অর্থনীতি, আরবি ইত্যাদি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) খোলা হয়।
পিসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শেখ বুলবুল কবির বলেন, শুধু জমিদার, বৃত্তবান শ্রেণি নয়; পিসি কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে এই অঞ্চলের নিম্নবিত্ত, সাধারণ মানুষের অবদানটাও অনেক বড়। সে সময়ে হরিণখানা এলাকার শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ বিনা পণে (মূল্যে) ১২ বিঘা জমি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য পিসি রায়ের হাতে তুলে দেন।
‘১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি বরিশালের মানুষ হলেও তার নির্বাচনী এলাকা ছিল বর্তমান বাগেরহাট অঞ্চল। শেরেবাংলার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পরে পিসি রায়ের অবদানের স্বীকৃতি দিতে বাগেরহাট কলেজের নামকরণ হয় ‘প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ’।
প্রফেসর কবির বলেন, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালস থেকে প্রতিবছর লাভের ৫ ভাগ এই কলেজে প্রদান করতেন। বেঙ্গল কেমিক্যালস বিনামূল্যে কলেজের বিজ্ঞানাগারের জন্য যন্ত্রপাতি প্রাদান করেন।
বাগেরহাটে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। সে সময়ে কলেজে জ্বলতো বিদ্যুতের আলো। এজন্য পিসি কলেজে নিজস্ব ডায়নামা বসানো হয়।
১৯৩৫ সালে স্থাপিত হয় জুবিলী ও ডি.বি নামক দুইটি ছাত্রাবাস।
জানা যায়, পিসি রায়ের মৃত্যুর (জুন ১৬, ১৯৪৪) পর বাগেরহাট টাউন নওয়াপড়ার জমিদার শৈলেন ঘোষের অর্থ সাহায্যে পিসি রায়ের ভাসকর্য স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৬ সালের ৩০ মার্চ বিচারপতি চারুচন্দ্র বিশ্বাস পিসি রায়ের ভাস্কর্য উদ্বোধন করেন।
১৯৬০ সালে এই কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার এবং হোস্টেলে আবাসনের ব্যবস্থা ছিল পাঁচশ ছাত্রের। এ সময় বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখায় স্নাতক (পাস) কোর্স চালু করা হয়। এখানে পড়তে আসতেন সাতক্ষীরা, যশোর, গোপালগঞ্জ এবং বরিশালের পশ্চিমাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা।
প্রফেসর বুলবুল কবির বলেন, ‘কলেজের সামনের রেল স্টেশনটির নাম ছিল বাগেরহাট কলেজ। ১৯৩১ সালে এই স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়। (বর্তমানে বাগেরহাটে রেল নেই) স্টেশনটি ভেঙে ফেলার পূর্ব পর্যন্ত এর নাম বাগেরহাট কলেজ ছিল।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালের ৭ মে প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়। এরপর সংক্ষেপ করে কলেজটির নামকরণ করা হয় সরকারি পিসি কলেজ, বাগেরহাট।
বর্তমানে কলেজটিতে ১৪টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান/অনার্স) ও ৯টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) কোর্স চালু আছে। প্রায় ২০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কলেজে বর্তমানে একাদশ-দ্বাদশসহ সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন।
শুরুতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকলেও কলেজটি পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে আসে। বর্তমানে কলেজটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে। গত বছর পিসি কলেজ খুলনা বিভাগে অষ্টম ও সারা দেশে ৮৯তম হয়।
কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক জ্ঞানী গুনী ব্যাক্তিরা এ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। যাদের মধ্যে অন্যতম শহীদ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন, কথাসাহিত্যিক আবু বকর সিদ্দিক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বাবা আযীমউদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
সরকারি পিসি কলেজের উপাধ্যক্ষ মোস্তাহিদুল আলম বলেন, শোকের মাস আগস্ট হওয়ায় বড় ধরনের কোনো অনুষ্ঠান থাকছে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে কলেজ চত্বর থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে। পরে পিসি রায়ের ভাস্কর্যে পুষ্পমাল্য প্রদান ও আলোচনা সভা হবে
এইচ//এসআই/বিআই/০৯ আগস্ট, ২০১৭