সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
মোরেলগঞ্জ থেকে: বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় পানগুছি নদীতে ট্রলার ডুবির তৃতীয় দিনে মা-ছেলেসহ আরও ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৬ জন।
বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) পানগুছি নদীর বিভিন্নস্থান থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার হয়।
গত মঙ্গলবার সকালে উপজেলার ছোলমবাড়িয়া খেয়া ঘাট থেকে মোরেলগঞ্জ পুরাতন থানার ঘাটে যাওয়ার পথে অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে এই ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। সে দিনই ৪ নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর প্রশাসনের কাছে নিখোঁজের অভিযোগ করেন ১৮ জনের স্বজনরা।
দুর্ঘটনার পর থেকে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, পুলিশ ও কোস্টগার্ড স্থানীয়দের সাথে নিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে।
বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারি পরিচালক মাসুদুর রহমান সরদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, বৃহস্পতিবার দিনভর উদ্ধার অভিযানে মা-ছেলেসহ ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরআগে, গত বুধবার এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ থাকা দু’জনকে জীবিত অবস্থায় খুলনার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাওয়া গেছে।
এরা হলেন- মোরেলগঞ্জ পৌর শহরের ভাইজোড়া গ্রামের আবুল কালামের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৪০) ও তার ছেলে জুবায়ের (১৪)। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সেখানে গিয়ে তাদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
ট্রলার ডুবির ওই ঘটনায় এখনও অন্তত ৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাগেরহাটের বৃহত্তম উপজেলার মোরেলগঞ্জের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে পানগুছি নদী। নদীর পশ্চিমে উপজেলা সদর, স্কুল-কলেজ, বাজার এবং পূর্ব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
নদীর দুই তীরে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের একটি মাত্র ফেরি থাকলেও তাতে কেবল গাড়ি পারাপার কারা হয়। সাধারণ মানুষের নদী পারাপারের একমাত্র ভরসা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার। প্রতিদিন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কয়েক হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে করে পার হয় ঘাটটি।
ট্রলার ডুবির পর থেকে এই ঘাট ব্যাবহারকারীদের মাঝে আত্মঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে পাশে গাড়ি পারাপারের জন্য ফেরিটি ব্যবহার করছে। পানগুছি নদীতে তীব্র স্রোত এবং নদীর নৌপথটি দিয়ে জাহাজসহ বিভিন্ন বড় বড় নৌযান চলায় ট্রলারের পারাপার ঝুকিপূর্ণ। তাই স্থানীয়রা সাধারণ মানুষের যাতায়েত নিভৃঘ্ন করতে ফেরি করে যাত্রী পারাপার ও খেয়া ঘাটির সুব্যবস্থাপনা দবি জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার উদ্ধার হওয়া ৯ জন হলেন, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের আলম চাপরাশির স্ত্রী মোসাম্মৎ সালমা বেগম (৩০), তার আঠোরো মাস বয়সী ছেলে মো. সাজ্জাদ, একই উপজেলার কাছিকাটা গ্রামের প্রয়াত কাসেম শেখের ছেলে মো. আব্দুল মজিদ শেখ (৭৫), নাসির শেখের ছেলে মো. নাজমুল (৬), আলতি বুরুজবাড়িয়া গ্রামের প্রয়াত গফ্ফার হওলাদারের ছেলে মো. সুলতান হাওলাদার (৫৫), হোগলাবুনিয়া গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে মো. রফিকুল ইসলাম (৩৫), বুরুজবাড়িয়া গ্রামের গফফার হাওলাদারের ছেলে আনছার হাওলাদার (৫০), গোপালপুর গ্রামের তবিবুর রহমান তোতার স্ত্রী মুন্নি বেগম (৪০) এবং শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজারের বাসিন্দা সামসুল হুদার ছেলে স্থানীয় রায়েন্দা পাইলট হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র আবির আল শামস্ (১৫)।
এরআগে মঙ্গল ও বুধবার সুফিয়া বেগম (৬০), তার মেয়ে বিউটি বেগম (৩৮), নাদেরা বেগম (২০), চেহের বানু (৫০) এবং রিমা বেগম (২৩) নামের চার নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
ট্রলারডুবির ঘটনায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন মোরেলগঞ্জ উপজেলার বারইখালী গ্রামের মো. বশিরের স্ত্রী মোসাম্মাৎ লাবনী (২০), উত্তর সুতালড়ী গ্রামের আ. আজিজের স্ত্রী মোসাম্মৎ কামরুন্নেছা (৫৮), শরণখোলা উপজেলার পল্লীমঙ্গল এলাকার মো. বাচ্চু বাদশার ছেলে রাহাত বাদশা (১০ মাস), একই উপজেলার খজুরবাড়ীয়া গ্রামের পুলিশ কনস্টেবল মো. শহিদের স্ত্রী মোসাম্মৎ নাছিমা, রায়েন্দা এলাকার মো. মহসীনের ছেলে মো. হাসিব (৬), পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানি উপজেলার পশ্চিম বালিপাড়া গ্রামের খলিল তালুকদারের স্ত্রী মোসা নাসরিন (২৮)। তাদের উদ্ধারে এখনও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া নৌবাহিনীর কমান্ডার মো. শাহরিয়ার আকন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, ট্রলারটি যে জায়গায় ডুবেছে তার দুই দিকে ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তল্লাশি অভিযান চলছে। সকাল সাতটা থেকে ৯টার মধ্যে পানগুছি নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭টি এবং দুপুরে একটি ও বিকালে একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতদের স্বজনরা তাদের সনাক্তের পর লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ নিয়ে ট্রলারডুবির ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৪। উদ্ধারকৃত মৃতদেহগুলো সনাক্তের পর স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য মো. ওবায়দুর রহমান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, এখনও ৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে অভিযান অব্যহত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলো তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
তদন্তের বিষয়ে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, আমরা তদন্ত কাজ শেষ করেছি। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
তদন্তে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসাবে ট্রলারে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং ঘাট ইজারাদারদের অব্যবস্থাপনাকে দায়ি করা হয়েছে।
তদন্তে উঠে এসেছে, বাগেরহাট-মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা রুটের চলাচল কারা বাসগুলোর সাথে মোরেলগঞ্জ ঘাটের ইজারাদারদের সাথে একটি আর্থিক লেনদেন রয়েছে। গাড়ির সব যাত্রী একটি ট্রলারে বোঝাই করাতে ট্রলার মালিক ও চালকেরা তাড়াহুড়া করে। যার কারণে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়।
এই খেয়া ঘাটে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে বেশ কিছু সুপারিশও করেছে তদন্ত কমিটি। যার মধ্যে অন্যতম- ঘাটের অব্যবস্থাপনা দূর করা, ট্রলারগুলোকে ফিটনেস দেখে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া, পানগুছি নৌরুটি দিয়ে চলাচলা করা বৃহৎ আকৃতির নৌযানগুলোকে ঘাট অতিক্রম করার সময় গতি কমানোর জন্য প্রচারণা চালানো।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত নির্ধারিত সময়ে তাদের তদন্ত কাজ শেষ করেছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এইচ/এসআই/বিআই/৩০ মার্চ, ২০১৭
** ট্রলারডুবি: আরও ৭ লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ ১০
** বাগেরহাটে ট্রলারডুবি: নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫
** ট্রলারডুবি: মা-মেয়েসহ ৪ জনের মৃত্যু, নিখোঁজ ১৮