নিউজ এডিটর | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলি-রে বাঙ্গালী/ তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাষাইলি।’ বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য তুলে ধরা মর্মস্পর্শী এ গানের রচয়িতা বাগেরহাটের চারণকবি সেখ সামছুদ্দীন।
মায়ের ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে রক্ত ঝরায় বাঙালি। ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র জনতার করা প্রতিবাদে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ছাত্র নিহতের প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামে গান লেখেন লোককবি সেখ সামছুদ্দীন। নিজের লেখা গান গেয়ে প্রতিবাদ জানান; নেমে আসেন রাজপথে।
তাঁর এ গান শুধু বাগেরহাটের ছাত্র-জনতাকেই নয়, সারা দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল শহীদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে লেখা এ গান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় স্মারক।
তবে, ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পার হলেও চারণকবি সেখ সামছুদ্দীনের বিখ্যাত এ গান আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান হিসেবে চারণকবি সেখ সামছুদ্দীন ও তাঁর গানকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবি বাগেরহাটবাসীর।
২০১২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত “চারণকবি সামছুদ্দীন আহমেদের গানের স্বীকৃতি চান তিনি” শিরোনামে সংবাদে বাগেরহাটের ভাষা সৈনিক ও শিক্ষক প্রয়াত মুনসুর আহমেদ উদ্ধৃত বলা হয়, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় বাগেরহাটের মহৎপ্রাণ মানুষ স্বভাবকবি সেখ সামছুদ্দীনের হৃদয় কেঁদে ওঠে। তিনি আমাদের আন্দোলনে শামিল ছিলেন, আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। গান লিখে আমাদের সভা-সমাবেশে গেয়ে শুনিয়ে ছাত্রদের উজ্জীবিত করতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই তিনি বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগের মহিমা তুলে ধরে মর্মস্পর্শী একটি গান রচনা করেন।’
পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাগেরহাটের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্তক ধর্মঘট পালন করা হয়। পরে সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক (সিসি ব্যাংক) মাঠে (বর্তমান- স্বাধীনতা উদ্যান) প্রতিবাদ সমাবেশে নিজের লেখা গান গেয়ে ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন সেখ সামছুদ্দীন। সেই থেকে লেখা ভাষা আন্দোলনের কালজয়ী গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে।
তাঁর লেখা ওই গানের সূত্র ধরে পল্লীকবি জসিম উদ্দিন, শিল্পি আব্বাস উদ্দিনসহ অনেক বিখ্যাত ও গুণী জনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে সামছুদ্দীনের।
জানা যায়, ১৯১৫ সালে বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার ব্যেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি কৃষক পরিবারের সন্তান সামছুদ্দীন।
তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট টাউন স্কুলে (বর্তমান বাগেরহাট বহুমুখি কলেজিয়েট স্কুল)। সেখান থেকেই জুনিয়র পাস করেন।
ছোটবেলা থেকেই ‘কবিতা ও গানে’র প্রতি অসাধারণ ঝোঁক ছিল চারণকবি সামছুদ্দীনের। বাল্যকাল থেকে ভক্ত ছিলেন পল্লীগীতির সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের।
পেশায় তিনি ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসয়ী। অবশ্য কেউ কেউ তাকে তেল বিক্রেতা বলেও উল্লেখ করেন।
তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। জীবিকার তাগিদে ছোট ছেলে থাকেন ঢাকায়। বড় ছেলে, পুত্রবধু ও নাতিরা বসবাস করেন বাড়িতে।
১৯৭৪ সালে এক প্রকার নিভৃতেই জীবনাসন হয় চারণ কবি সামসুদ্দীনের।
চারণকবি সেখ সামছুদ্দীনের বড় ছেলে শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমার বাবা গরীব ছিলেন। হাট-বাজারে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন আর গান বাঁধতেন। অভাবের কারনে আমরা লেখাপড়াও করতে পারিনি।
কবির বড় মেয়ে লায়লি বেগম বলেন, আমার বাবার অনেক লেখা ছিলো। তিনি মুক্তিযোদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাদের কাছে পরিচিয় ছিলেন। তারা তার গান পছন্দ করতে। তাই প্রাণ ভয়ে যুদ্ধের সময় তিনি তার অধিকাংশ গান এবং স্মৃতি পুড়য়ে ফেলেন।
তবে এখনও কবির পরিবারের কাছে তার ব্যবহৃত একটি একতারা সংরক্ষিত আছে।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার লেখা গান এখনও সবার মুখেমুখে। তবে সেই অবদানের কোন স্বীকৃতি সেভাবে মেলেনি। তাই সরকারের কাছে রাষ্ট্রিয় ভাবে তার স্বীকৃতি প্রদানের দাবি তাঁর সন্তানদের্
ড. শেখ গাউস মিয়ার ‘মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ বাগেরহাট’, স্বরোচিষ সরকারের ‘বাগেরহাটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বইয়ে সামছুদ্দীনের রচনা করা গানটি স্থান পেয়েছে। ‘রাষ্ট্রভাষা’ গানটির কথা উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের খ্যাত লেখক ও সংষ্কৃতি ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীও।
সাম্প্রতি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সাংস্কৃতি গ্রন্থমালা – বাগেরহাট’ বইতেও উল্লেখ আছে এই চারণ কবির কথা।
স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বাগেরহাট জেলা পরিষদের উদ্যোগে কবির কবরটি সংরক্ষিত করে তা বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং একটি গেট নির্মান করা হয়। এছাড়া ভাষা আন্দোলনে তার অবদানের জন্য বাগেরহাট ফাউন্ডেশন, একটি বেসরকারি মোবাইলফোন অপারেটর ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কবিকে মরণোত্তর সনদ ও ক্রেষ্ট দিয়েছে।
তবে, এখন রাষ্ট্রিয়ভাবে তাকে কোন সম্মাননা বা তার বিষয়ে কোন গবেষণা হয়নি।
কবিকে রাষ্ট্রিয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান এবং তার গানগুলোকে সংরক্ষণের পাশাপাশি চারণকবি সেখ সামসুদ্দীনকে একুশে পদকে ভূষিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় গবেষক ও এনজিও কর্মকর্তা সুব্রত কুমার মুখার্জী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, চারণ কবি সামছুদ্দীন বহু লোক গানের রচয়িতা। সংরক্ষনের অভাবে তার বহু গান গান হারিয়ে গেছে। তাকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোন গবেষণা না থাকায় বিভিন্ন লেখক তাকে নানা ভাবে উপস্থাপন এবং বিকৃতি করেছে।
চারণকবি সামছুদ্দীনের লেখা ১৬টি গান নিয়ে ১৯৫৩ সালে খুলনা থেকে ‘পাকিস্তান পল্লীগীতি’ নামে একটি সংকলন বই প্রকাশ হয়েছিলো।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত কবি সেখ সামছুদ্দীনের প্রকাশিত বইটি এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও তা সংরক্ষণে রেখেছিলেন বাগেরহাটের আইনজীবি এ্যাড. সলিমুল্লাহ এলিন। তিনি বলেন, পাকিস্তান পল্লীগীতি নামে ওই বইটিতে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ‘রাষ্ট ভাষা’ গানটিসহ ৩টি একুশের গান রয়েছে। বইটিতে কবির লেখা তিনটি বইয়ের তথ্য রয়েছে।
চারণকবি সামছুদ্দীনের লেখা সকল গান ও কবিতা এবং তার স্মৃতিগুলো যথাযথ ভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।
বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর শওকাত আলী বাদশা বলেন, চারণকবি সেখ সামছুদ্দীনের লেখা গানটি ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে ভূমিকা রাখে। বাগেরহাটবাসীর প্রত্যাশা কালজয়ী এই গানের রচয়িতা সৃষ্টিশীল কবি সামছুদ্দীনকে রাষ্ট্রিয়ভাবে স্বীকৃতি ও সম্মাননা জানানো হোক।আমিও এই দাবির সঙ্গে একমত।
সারাদেশে ভাষাসৈনিকদের সম্মানিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। তেমনিভাবে এই গানের রচয়িতা কালজয়ী এ কবিও যেন স্বীকৃতি পায় এজন্য আমি চেষ্টা করব।
এইচ/এসআই/বিআই/২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭