স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
সুন্দরবনের ‘করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র’ থেকে হটাৎ করে উধাও হওয়া কুমির ছানাগুলোকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছে বন বিভাগ।
কুমির ছানাগুলো বন কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যোগসাজশে করমজল কেন্দ্র থেকে ‘পাচার’ করা হয়েছে এমন গুঞ্জনের মাঝে বন বিভাগ বলছে এগুলোকে হত্যা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) প্রজনন কেন্দ্রের দুটি প্যান (কৃত্রিম পুকুর) থেকে ৪৩টি কুমিরের বাচ্চা নিখোঁজ হবার বিষয়টি স্বীকার করে বন বিভাগ। গেল ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি দুই দফায় প্রজনন কেন্দ্রে প্যান (খাঁচা) থেকে কুমির ছানাগুলো নিখোঁজ হয়।
অভিযোগ ওঠে বন বিভাগের লোকদের যোগসাজশে কুমির ছানাগুলোকে পাচার হয়েছে। যদিও প্রথমে ঘটনাটিকে শেয়ালে কুমিরের বাচ্চা নিয়ে গেছে বলে প্রচার কেন্দ্রের দায়িত্বরত বন কর্মীরা।
অবশ্য “শেয়ালের কুমিরের বাচ্চা গোনা কাহিনির” মতো ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার ওই চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর বন বিভাগ বিষয়টিকে ‘চুরি’ বলে চালানোর চেষ্টা করে।
তবে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে বাংলানিউজকে বলেন, “কেন্দ্রের দু’টি প্যান থেকে নিখোঁজ কুমিরের বাচ্চাগুলোকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে আমরা প্রমান পেয়েছি। বাচ্চাগুলোর অধিকাংশের বয়স ৬ মাস। এছাড়া এক থেকে দেড় বছর বয়সী কয়েকটি বাচ্চাও রয়েছে।”
ডিএফও’র ভাষ্য, ২৯ জানুয়ারি ভোরে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রর প্যানে ৩৬টি কুমিরের বাচ্চা কম থাকার বিষয়টি নজরে আসে কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তার। তখন প্যানের দেখা শোনার দায়িত্বে থাকা লস্কর (বনকর্মী) মাহাবুব হোসেন জানান বাচ্চাগুলোকে শেয়ালে নিয়ে গেছে। তবে শেয়ালে বাচ্চা নেওয়ার মতো প্যানে কোনই লক্ষণই ছিলো না। প্যানের খাঁচার কোন অংশ ছেড়া কিম্বা সেখানে রক্ত বা কুমিরের বাচ্চার শরীরের কোন বিচ্ছিন্ন অঙ্গও পাওয়া যায় নি।
পরদিন ৩০ জানুয়ারি ভোরে প্যানে আরও ৭টি বাচ্চা কম পাওয়া যায়। সব মিলে দুটি প্যান থেকে মোট ৪৩টি কুমিরের বাচ্চা নিখোঁজ হবার বিষয়টি জানতে পেরে চাদঁপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মেহেদীজ্জামানকে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ডিএফও সাইদুল ইসলাম বলেন, প্রথম দিকে এসিএফ-কে কুমিরের দেখা-শোনার দায়িত্বে থাকা বনকর্মী (লস্কার) মাহাবুব হোসেন বাচ্চাগুলেকে শিয়াল বা বন বিড়ালে নিয়ে গেছে বলে দাবি করে। তবে প্রথমিক তদন্তে উঠে এসেছে বাচ্চা গুলোকে হত্যা করা হয়েছে।
এরই মধ্যে করমজল কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে মৃত অবস্থায় ৬টি বাচ্চা পাওয়া গেছে। এছাড়াও আরও দু’টি বাচ্চার বিচ্ছিন্ন মাথা ও একটি লেজ পাওয়া গেছে।
কুমির ছানাগুলো হত্যার কারণ জানতে চাইলে ডিএফও বলেন, করমজল কেন্দ্রর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তহিদুল ইসলাম ও কেন্দ্রে লস্কর (বনকর্মী) মাহাবুব হোসেনের মধ্যে বিরোধের ছিলো। ২৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ওসি তহিদুলের সঙ্গে ওই কেন্দ্রের লস্কর মাহাবুব হোসেনের কথা কাটাকাটি হয়। তখন ওসিকে দেখে নেবারও হুমকি দেয় মাহাবুব।
প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে ওই বিরোধের জের ধরে ওসিকে বিপদে ফেলতেই লস্কর কুমির ছানাগুলোকে হত্যা করেছে।
ঘটনা তদন্তে এসিএফ-এর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের কমিটির প্রতিবেদন হাতে পেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জনা যাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে, প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কেন্দ্রের লস্কর (বনকর্মী) মাহাবুব হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বন বিভাগ। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী জাকির হোসেনকেও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। জাকিরের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
আগামী রোববার এসিএফ-এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর লস্কর মাহাবুবের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে ডিএফও।
বন বিভাগের পক্ষ থেকে কুমিরগুলোকে হত্যার কথা বলা হলেও ওই ৪৩টি কুমিরের অধিকাংশ পাচার হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, প্রথম দিনের পাচারের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে পরের দিনে কয়েকটি কুমিরে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। মুলত পাচারের বিষয়টি যেন প্রকাশ না পায় তাই কয়েকটি কুমির ছানা হত্যা করে কোন বন্য প্রাণী এগুলোকে হত্যা করেছে প্রমানের চেষ্টা হয়েছে।
ঘটনাস্থল করমজল কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তহিদুল ইসলামকে বন বিভাগের তদন্ত কমিটিকে রাখার বিষয়টিকেও রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে, এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান এসিএফ মেহেদীজ্জামান ও কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তহিদুল ইসলামরে সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন রিসিফ করেন নি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ সূত্র জানায়, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির নোনা পানির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে ২০০২ সালে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজলে দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর জন্য বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন প্রকল্পের ৩২ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
শুরুতে জেলেদের জালে ধরা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি কুমির দিয়ে কেন্দ্রে প্রজনন কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে কেন্দ্রে নোনা পানির দু’টি নারী কুমির-জুলিয়েট ও পিলপিল এবং একটি পুরুষ কুমির রোমিও রয়েছে।
করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রের সাবেক কর্মকর্তা ও কুমির বিশেষজ্ঞ আবদুর রব বলেন, বাংলাদেশে তিন প্রজাতির কুমিরের অস্তিত্ব ছিল। লবণ পানির কুমির, মিঠা পানির কুমির ও গঙ্গোত্রীয় কুমির বা ঘড়িয়াল। এর মধ্যে মিঠা পানির কুমির ও ঘড়িয়ালের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। শুধু টিকে আছে লবণ পানির কুমির। এই প্রজাতির কুমির সাধারণত ৬০-৬৫ বছর পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। আর গড় আয়ু ৮০-১০০ বছর পর্যন্ত।
প্রজনন কেন্দ্রে থাকা ২৭৭টি কুমিরের মধ্যে চুরি হওয়ার পর বর্তমানে ৩টি বড় কুমিরসহ মোট ২৩৪টি কুমির রয়েছে।
এইচ/এসআই/বিআই/০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
** সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রর ৪৩টি কুমির ছানা উধাও