নিউজ এডিটর । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
সবুজে ঘেরা গ্রাম সুড়িগাতি। গ্রামের মাঝ দিয়ে পিছঢালা সরু পথ। দু’ পাশে ছোট বড়-গাছপালা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের। মাঝে মাঝে আছে বসত ঘর। দেখতে ছবির মতো হলেও বাতাসে ভেষে এলো একটা দুর্গন্ধ। সামনে এগোতে ধিরে ধিরে বাড়ে গন্ধতাটা। এরই মাঝে নারী-পুরুষ ও শিশুরা ব্যস্ত শামুকের খোলোস থেকে মাংস আলাদা করার কাজে।
কথা বলে জানা গেল তারা সবাই ‘শামুক শ্রমিক’। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাস্তার পাশে শত শত নারী-পুরুষ ও শিশু এভাবে শামুক ভাঙেন এখানে। শুধু সুড়িগাতি নয় পার্শবর্তি বারাশিয়া, ডুমুরিয়া, খিলিগাতি, রায়গ্রাম, জলডাঙ্গাসহ চিতলমারী উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে; বিশেষ করে নারীদের পেশা এখন শামুক ভাঙ্গা। দুই দশকের বেশি সময়ে শামুক ভাঙা এই পেশায় যুক্ত হয়েছে ফকিরহাট, মোল্লাহাটসহ এ অঞ্চলের কয়েকটি উপজেলার হাজার হাজার দরিদ্র জনগষ্ঠি।
বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মিঠা পানির বাগদা চিংড়ি ঘের গুলোতে প্রধান খাবার হিসাবে খাওয়ানো হয় শামুকের শাস বা মাংস (শামুকের ভেতরের নরম অংশ)। এ জন্য প্রতিদিন গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, পিরোজপুর, বরিশাল, ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক ও ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে শামুক আনা হয় এই এলাকায়।
ঘের মালিক ও এক শ্রেণির শামুক ব্যবসায়িরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যাপারিদের কাছ থেকে কিনে আনের এসব শামুক। পরে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠি বিশেষ করে নারীদের দিয়ে স্বল্প মূল্যে ভাঙ্গানো হয় এ শামুক।
চিতলমারী উপজেলার সুড়িগাতি পালপাড়া গ্রামের বাগদা চিংড়ি চাষি আতাউর রহমান (৫২)। দুই ভাই ও নিজের মিলিয়ে প্রায় ৭৫ বিঘা জমিতে ছোট বড় ৫টি বাগদা চিংড়ি’র ঘের তাদের। ঘেরগুলোতে চিংড়ির খাবার হিসাবে দেওয়া হয় শামুকের মাংস। আনন্দ মন্ডল (৪২) নামে স্থানীয় এক শামুক ব্যবসায়ি শামুকের শাস বা মাংস সরবরাহ করেন তাদের ঘেরে। ‘বালতি, ঝুড়ি এবং বস্তা হিসেবে ব্যাপারিদের আনা শামুক কিনি আমরা। কিনে আনা শামুক গুলো টাকার বিনিময় গ্রামের লোকদের দিয়ে খোসা ও মাংস আলাদা কারা হয়। পরে ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করি।’ বললেন আনন্দ মন্ডল।
সুড়িগাতি গ্রামের শামুক শ্রমিক রানী বিশ্বাস (৩১) বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘বস্তা হিসেবে শামুক ছাড়াই। এক বস্তা শাস ছাড়ালি ৫০ টাকা পাই। প্রতিদিন এক জনে শামুক থেকে বস্তা দুই শাস ছাড়াতি পারে। এই কাজ করতি যাইয়ে হাতে পায় ঘা-পাচড়াও হয়। কিন্তু টাহার জননি (টাকার জন্য) শামুক খোলাই লাগে।’
একই গ্রামের শরৎ চন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী অনিতা মজুমদার (৩৩) জানান, বছরে প্রায় ছয় মাস শামুক খোলার কাজ পাওয়া যায়। গ্রামে অন্য কোন কাজের সুযোগ না থাকায় সাংসারে বাড়তি কিছু আয়ের জন্য এই কাজ করেন তিনি। কাজ না পেলে স্বামীও সে দিন শামুক খোলেন। এই আয় দিয়ে দুটি সন্তানকে স্কুলেও পাঠাচ্ছেন তিনি।
এলাকার সাধারণ মানুষ, চিংড়ি ঘের মালিক, ব্যবসায়ি, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী সবাই জানালেন শামুকের মাংস গলদা চিংড়ির প্রিয় খাবার।
ফকিরহাটের ফলতিতা গ্রামের চিংড়ি চাষি আলাউদ্দিন টিপু (৪৯) বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, বৈশাখ মাসের শেষ দিক থেকে ঘেরে চিংড়ির পোনা ছাড়া হয়। দু মাস পর অথাৎ আষাঢ় মাস থেকে চিংড়ি ঘেরে খাবার হিসাবে শামুক দেওয়া হয়। এসময় শামুকও পাওয়া যায় বেশ। তবে বর্তমানে এই এলাকার মুক্ত জলাশয় ও বিল গুলোতে যে আগের মতন আর শামুক পাওয়া যাচ্ছেনা শিকার করলেন তিনি।
চিতিলমারীর ডুমুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরেন্দ্রথান রানা বলেন, শামুক ধরা নিয়ে নেই সরকারি কোন নিতিমালা। বেসরকারি উদ্যোগেও নেই বিশেষ কোন সচেতনতা কর্মসূচি। এই সুযোগেই গলদা চিংড়ির খাবার হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে শামুকের বাজার।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৯ উপজেলার মোট ৭০ হেক্টর জমিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক জমিতে ৩০ হাজার ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়।
শুধু চিংড়ির খাবর হিসাবে নয়। শামুকের খোসা ব্যবহৃত হয় মাছ ও হাস-মুরগীর খাবার (ফিস ফিড, পোল্টি ফিড) তৈরিতে। তাছাড়া পানের সাথে খাবার চুন হিসাবেও শামুখের খোসা ব্যবহৃত হয়। এজন্য শাস বা মাংস বের করার পর স্তুপ করে রাখা হয় শামুকের খোসা।
বাগেরহাটের শামুক ব্যাবসা নিয়ে কেয়ার বাংলাদেশের গবেষণা (২০০১) অনুয়ায়ী দেশে প্রথম শামুক আহরণ শুরু হয় বাগেরহাট থেকে। নির্বিচারে শামুক সংগ্রহের ফলে এখানে শামুক কমতে থাকে। চাহিদা থাকায় বরিশাল, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজশাহীসহ ১৩ জেলায় শামুক সংগ্রহ শুরু হয় ২০০০ সালের আগে থেকে।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৫০ হাজার প্রজাতির শামুক আছে। যার মধ্যে মাত্র ৫ হাজার প্রজাতির স্বাধু বা মিষ্টি পানির। অবশ্য বাংলাদেশে কত প্রজাতির শামুক আছে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ তালিকা নেই। তবে সমুদ্র, নদ-নদী, বিল-হাওড় মিলে দেশে প্রায় ৪৫০ প্রজাতির শামুক আছে বলে জানা যায়। স্থানীয় পরিবেশ রক্ষায় যেগুলোর প্রত্যেকটিরই নানাবিধ গুরুত্ব রয়েছে।
বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং উদ্ভিদ ও প্রাণি বিজ্ঞানের শিক্ষক প্রফেসর বুলবুল কবির জানান, শামুক প্রাকৃতিক ভাবে পানিকে শোধন করে। শামুক নিধনের ফলে কৃষিজমি ও পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্যতা নষ্ট হচ্ছে।
বাগেরহাটে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. এমদাদুল হক বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, শামুক পরিবেশ ও জলজ প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। একে প্রকৃতির ফিল্টার বলা হয়। শামুক না থাকলে পানির প্রাকৃতিক শোধন ক্ষমতা হ্রাস পাবে। তাছাড়া মুক্ত জলাশয়ে দেশিয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের খাবার এই শামুক। নির্বিচারে শামুক নিধনে বিভিন্ন প্রজাতির দেশিয় মাছ ও ফসলের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ বিভাগের ডিরেক্টর (ইন-চার্জ) এ এস মনিরুজ্জামান খান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, কৃষিজমি ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিকভাবেই শামুক জন্মায়। বিশেষ করে হাওড় ও বিল এলাকাগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির শামুকের আধিক্য বেশি। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বিলগুলোতেও একসময় প্রচুর শামুক দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে এদের সংখ্যা একেবারে কমে এসেছে।
যার প্রধান কারণ এ শামুকগুলো চিংড়ির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। যদিও একসময় এ শামুকগুলো সধারণত গৃহপালীত হাঁসের খাবার হিসেবেই ব্যবহার হত। গত ২০ বছরে চিংড়ির খাবার হিসাবে শামুকের ব্যবহার এতোটাই বেড়েছে যে, দক্ষিণাঞ্চল বিল ও জলাভুমিগুলো থেকে আজ শামুক বিলুপ্তির আশংকা দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে এই শামুকগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থায় বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আমরা যে হারে শামুক উত্তোলন করছি তাতে আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থার উপরেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে তা নয়, সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি ধ্বংস হতে পারে। সবচাইতে যে সম্পদ এর উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে তা হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মৎস প্রজাতি। কারণ, এই শামুক গুলো তাদের প্রধান খাদ্য।
বেশ কিছু বছর যাবত আমরা দেখতে পাচ্ছি হাওয়র অঞ্চল থেকে শামুক সংগ্রহ করে দক্ষিণাঞ্চলে আনা হচ্ছে। এ ব্যবস্থাটি এখনই বন্ধ হওয়া উচিৎ। আর তা না হলে হাওয়র প্রতিবেশ ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকীর মধ্যে পড়বে বলে মন্তব্য করেন মনিরুজ্জামান খান।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ খুলনার সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) জাহিদুল কবির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, গোল শামুক বা আপেল শামুক নামে পরিচিত প্রজাতির শামুক আহরণ এখনও বিশেষ বিধিনিষেধ যুক্ত নয়। তবে সকল প্রজাতির শামুকই বন্য প্রাণীর অন্তরভূক্ত। আর যে কোন প্রকার বন্য প্রাণী ধরা, মরা, পরিবহণ বা বাজারজাত করা সম্পূর্ণ বে-আইনি। যে প্রকৃয়ায় শামুক আহরণ ও বাজারজাত হচ্ছে তা অবৈধ।
পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণী একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। শামুক না থাকলে শামুকের উপর নির্ভরশীল পাখিসহ অন্য জলজ প্রাণীর উপর এর প্রভাব পড়বে। বিষয়টি নিয়ে বন বিভাগও উদ্বিগ্ন। এব্যাপারে বন বিভাগ সুনিদৃষ্ট পদক্ষেপ ও নিতিমালা প্রনয়নের কথা ভাবছে বলে জানান ওই বন কর্মকর্তা।
এসআইএইচ/বিআই/২১ জুলাই, ২০১৬