অলীপ ঘটক, চিফ নিউজ এডিটর | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
‘পরিবেশ দূষণ হচ্ছে জেনেও নিরূপায় হয়ে আমরা নদীতে বর্জ ফেলছি। পৌর কর্তৃপক্ষ ভৈরব নদীর পাড়ে পশু জবাই করার স্থায়ী জায়গা করে দিলেও বর্জ্য ফেলার কোন জায়গা দেয়নি।’
বাগেরহাট পৌরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন শহরের প্রধান বাজারের একাধিক মাংস ও সবজি বিক্রেতারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নদীতে পশু বর্জ্য এবং সবজির অবিক্রিত নষ্ট অংশ ফেলে পরিবেশ দূষণের কথা এভাবেই অকপটে স্বীকার করেছেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকের কাছে।
বাগেরহাট শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের তীরে বাজার এলাকায় সরজমিনে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে।
বাগেরহাট শহরের লক্ষাধিক মানুষকে জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন থেকে রক্ষা করতে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে ভৈরব নদের তীর ঘেষে নির্মিত শহর রক্ষা বাঁধ। ২০০৫ সালের ১২ এপ্রিল উদ্বোধনের পর থেকেই বাঁধের পাশ দিয়ে নদী দখল ও বিভিন্ন ভাবে দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে।
বর্তমানে শহরের প্রধান পাঁচটি ড্রেন থেকে সরাসারি বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। মুনিগঞ্জ থেকে দড়াটানা পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধের পাড়ে বিভিন্ন স্থানে ময়লা ফেলে স্তুপ করা হয়েছে। পাশাপাশি মাটি ফেলে ভরাট করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং বিভিন্ন মালামাল রেখে দখল করা হচ্ছে নদী তীর।
ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শহরের বাসিন্দারাও ময়লা ফেলছে নদীতে। এভাবে অযন্ত আর ময়লা আবর্জনা ফেলে দখল দূষণ অব্যহাত থাকলে বাগেরহাটের সৈন্দর্য্য ভৈরব নদ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পূরপূরি নাব্যতা হারাবে বলে আশঙ্কা পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের।
অন্তত পাঁচ বছর আগে গনস্বাক্ষরতা অভিযান ও জাগ্রত যুব সংঘ (জেজেএস) আয়োজিত পরিবেশ ও বাগেরহাট বিষয়ক এক সংলাপে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলা হয়, বাগেরহাট জেলায় ৪১ টি নদী, পাঁচশত ৪৭ টি খাল ও ২২ টি বিল রয়েছে। এর অধিকাংশ নদী খালে স্বাভাবিক জোয়ারের পানি প্রবাহ না থাকায় নাব্যতা হারিয়ে চর জেগেছে এবং ভূমি দস্যুদের দখলে চলে গেছে।
বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ ও বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্য অধ্যাপক কমল কুমার ঘোষ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর মতো দূষণ আর দখলে অস্তিত্ব সংকটের দিকে এগুছে বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদ।
যে ভৈরব নদকে কেন্দ্র্র করে আজকের বাগেরহাট শররের গোড়া পত্তন। অব্যবস্থাপনা অার নিষ্ঠুরতায় সেই ভৈরবই এখন জৌলুস হারাচ্ছে। অব্যাহত দূষণ ও ভরাটের ফলে দিনে দিনে মরা খালে রুপ নিচ্ছে প্রিয় ভৈরব।
ফাউন্ডেশন ফর ইকোলজিক্যাল এন্ড এনভায়রণমেন্টাল ডেভলপমেন্ট (ফিড) এর নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান টুলু বলেন, যত্রতত্র নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলায় ভৈবর নদের একাধিক স্থানে চর জেগে উঠেছে। আর এই চরে গড়ে উঠতে শুরু করেছে অবৈধ স্থাপনা। ভৈরব নদের ওপর নির্মিত শহর রক্ষা বাঁধ এলাকায় বর্জ্য ফেলে পানি দূষণ ও নদী ভরাট করা হচ্ছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বাগেরহাট জেলা শাখার সভাপতি এ্যাডভোকেট রামকৃষ্ণ বসু বলেন, ভৈরব নদের অবস্থা দেখলে খারাপ লাগে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি এই শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ভৈরবের শাখা বালিয়ার খালে বড় বড় নৌকা ভিড়ত।
সেই খালটি মরে যাওয়ার পর পৌর কর্তৃপক্ষ খালটিকে ড্রেনে রূপ দিয়েছে। বেঁচে থাকা এই অবশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী নদীটির উপর আমরা অত্যাচার করছি। নদীটিকে রক্ষার ব্যবস্থা করতে জেলা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান মুজিবর রহমান বলেন, প্রকৃতির ওপর আমরা বৈরী আচরণ করছি। নদীর পাড়ে বসবাস করা বাসিন্দারা এবং সবজি ও মাংস বিক্রেতারা তাদের ময়লা আবর্জনা, মলমূত্র যত্রতত্র নদীতে ফেলে দূষণ করছে। নদী দূষণ রোধ করতে এদের সচেতন করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বাগেরহাট পৌরসভার মেয়র খান হাবিবুর রহমান বলেন, পরিবেশ দূষণ রোধ করতে পৌর কর্তৃপক্ষ সব সময় সচেতন রয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধ সংলগ্ন বাগেরহাট বাজারের ব্যবসায়ীদের ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট একটা স্থানে রাখতে বলা হলেও তারা তা না রেখে অনেক সময় নদীতে ফেলে দিচ্ছেন।
নদী দূষণের কথা স্বীকার করে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাংগীর আলম বলেন, অসচেতন ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত ময়লা আবর্জনা নদে ফেলে নদী দূষণ করছে। নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে জেলা প্রশাসন সব সময় সতর্ক রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদকে দূষণমুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এজি/এসআই/বিআই/২৯ জুন, ২০১৬