স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
মংলা থেকে: আত্মশুদ্ধি করে মাষ্টার বাহিনীর মতো আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অন্য দস্যুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
মঙ্গলবার (৩১ মে) বাগেরহাটের মংলা বন্দরের বিএফডিসি জেটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে মাস্টার বাহিনীর ১০ দস্যুর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
মাস্টার বাহিনী বর্তমান সময়ে সুন্দরবনের সর্ববৃহৎ এবং কুখ্যাত দস্যুদল হিসাবে জেলে বাওয়ালীদের কাছে ত্রাস নাম ছিল। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল সুন্দরবন ছাড়াও উপূলের কয়েক লাখ জেলে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছে দস্যুরা ৫২ টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রায় ৫ হাজার রাউন্ড গুলি জমা দিয়েছে।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাস্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দস্যুদের উদ্দেশ্যে বলেন, বনদস্যুরা সমাজের ক্ষতিকর মানুষ হিসাবে রুপ নিয়েছে। এই উপলব্ধি থেকে তারা আজ আত্মসমর্পণ করেছে। বনে দস্যুবৃত্তি যে ভুল ছিল তা মাষ্টার বাহিনী বুঝতে পেরেছে তাই তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আত্মসমর্পণ করেছে। সুন্দরবনে অন্য যে বাহিনীগুলো এখনো দস্যুতা করছে তারাও তাদের আত্মশুদ্ধি করে মাষ্টার বাহিনীর মতো আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মন্ত্রী আরও বলেন, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালরা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে সেজন্য কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
এজন্য তাদের বহরে চারটি আধুনিক জাহাজ আনা হয়েছে। জনবল বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি নৌ-পুলিশ টহলেরও উদ্যোগ নেয়া হবে।
সুন্দরবন পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। তাই সুন্দরবনকে সুরক্ষিত করতে যা যা প্রয়োজন তার সবই করবে সরকার।
অন্যান্য দস্যুদের উদ্যেশ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা যদি ভয়ঙ্কর পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় তাহলে সরকার তাদের সব ধরনের আইনী সহায়তা দেবে। আর তারা যদি বনে দস্যুবৃত্তি করতে চায় তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কঠোর হাতে দমন করতে ব্যবস্থা নেবে বলেও হুঁশিয়ার করেন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (গোয়েন্দ) কর্নেল আনোয়ার হোসেন, খুলনা রেঞ্জের পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামানসহ র্যাব কর্মকর্তা ও প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সুন্দরবনে মাস্টার বাহিনীর উত্থান-
মূলত ২০১৫ সালে সুন্দরবনের নিরীহ জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালী অপহরণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাধ্যমে চাঁদা আদায়ে সবচেয়ে সক্রিয় দস্যুদল “মাস্টার বাহিনী’।
র্যাব জানায়, ২০১১ সালের ১২ নভেম্বর সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের নারিকেলবাড়িয়া এলাকায় দস্যু রাজু বাহিনীর আস্তানায় অভিযান চালায় র্যাব-৮। অভিযানে রাজুর আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই সময়ে রাজু বাহিনীর এক বনদস্যুও গুলিবিদ্ধ হয়।
ঐ ঘটনার পর বাহিনী প্রধান ভারতে পালিয়ে যায়। এর পর দলটি চারটি ভাগে (নোয়া, ফরহাদ, ইলিয়াস ও জাহাঙ্গীর) বিভক্ত হয়ে পড়ে। সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় এই বাহিনীর বিভক্তির ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যে সৃষ্টি করে।
জেলেরা জানায়, রাজু বাহিনী বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর “মাস্টার বাহিনীর’’ বর্তমান সক্রিয় জলদস্যুরা বাকী বিল্লাহ ওরফে নোয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন “নোয়া বাহিনীতে’’ যোগ দেয়। মোস্তফা শেখ, কামরুল শেখ, সোহাগ আকনসহ দুর্ধর্ষ জলদস্যুরা মিলে সর্বাপেক্ষা বেশী অস্ত্র সরঞ্জাম নিয়ে “নোয়া বাহিনী’’ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে; ২০১২ ও ২০১৩ সালে সুন্দরবন ও বন সংলগ্ন সাগরে ব্যাপক দস্যুতা চালায়।
তবে ২০১৩ সালের শেষ দিকে মুক্তিপণের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নোয়া বাহিনীতে নেতৃত্বের বিরোধ দেখা দেয়; ক্রমান্বয়ে ওই বিভেদ প্রকট হয়। রার অস্ত্র দিয়ে চলা বাহিনীর দস্যুতার অর্থ যেতে ভারতে অবস্থানরত রাজুর কাছে। তবে আর্থিক কারনে বিভেদ এবং প্রতিপক্ষ “জাহাঙ্গীর বাহিনী’’ ও “ইলিয়াস বাহিনীর’’ প্ররোচনায় “নোয়া বাহিনী’’ বিভক্ত হয়ে যায়।
এসময় নিজেদের দন্দ্বে আহত হয়ে বাকী বিল্লাহও ভারতে পালিয়ে যায়।
জেলে বাওয়ালী সূত্র জানায়, এর পরই রাজুর বিপুল অস্ত্র-গোলাবারুদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে কুখ্যাত দস্যু মোস্তফা শেখ ওরফে মোস্তফা মাস্টার। ২০১৪ সালের শুরু দিকে গঠন করেন ‘মাস্টার বাহিনী’। সুন্দরবন ও সংলগ্ন সাগর উপকূলে শুরু করে দস্যুতা।
২০১৫ সালের ০১ এপ্রিল বাগেরহাটের রামপালের কাটাখালীতে র্যাব অভিযানে ওই বাহিনীর অন্যতম এক সদস্য এবং বাহিনী প্রধান মোস্তফা শেখ এর ছোট ভাই কামরুল শেখ নিহত হন।
সবশেষ গেল ইলিশ ও শুটকি মৌসুমে “মাস্টার বাহিনী’’ ব্যাপক দস্যুতা করে। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরার মান্দারবাড়িয়া, হিরণ পয়েন্ট, কালীর চর, বঙ্গবন্ধুর চর সংলগ্ন সাগর ও মোহনা সমূহে জেলে অপহরণ করে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় শুরু করে।
র্যাবের অব্যাহত অভিযাতে বিভিন্ন বাহিনী কোনঠানা হয়ে পড়লেও সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল মাস্টার বাহিনী। মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শেষ হলো এই অধ্যায়।
এই ধারাবাহিকতায় অনান্য বাহিনী ও দস্যু দলগুলোও দ্রত আত্মসমর্পণ করে বলে আশা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্টদের।
এজি/এসআই/বিআই/৩১ মে, ২০১৬