বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন না করতে ভারতের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক বা এক্সিম ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্বের ৯৬টি পরিবেশবাদী ও নাগরিক সংগঠন।
বাগেরহাটের রামপাল কয়লা ভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে এমন আশঙ্কা তুলে সংগঠনগুলো এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে একটি খোলা চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে সংগঠনগুলো বলেছে, আগামী জুলাইয়ের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১৬০ কোটি ডলার ঋণ মঞ্জুর করতে যাচ্ছে। যা এক্সিম ব্যাংকের কথার বরখেলাপ। ব্যাংকটির কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা বিশ্বের নাগরিকদের স্বার্থে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ধ্বংস ডেকে আনবে।
সংগঠনগুলো থেকে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৭৯ লাখ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। এক টানা ২৫ বছর ওই পরিমাণে কার্বন নির্গত হওয়ার ফলে তা সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে এখন মাত্র ১০০টি বাঘ রয়েছে। বিদ্যুৎ প্রকল্পটির কারণে বাঘের জীবন বিপন্ন হবে।
এক্সিম ব্যাংকের কাছে দেওয়া ওই আবেদন সম্পর্কে ভারতের জনবিজ্ঞান প্রচারাভিযানের সৌম্য দত্ত বলেন, এক্সিম ব্যাংকের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে অস্বাভাবিক পরিমাণে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষ ও সুন্দরবনের প্রতি এক ধরনের অপরাধ। শুধু এই প্রকল্পের কারণেই বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে।
চিঠিতে সাক্ষরকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭টি সংগঠন ভারতের। এর পরেই যুক্তরাষ্ট্রের নয়টি, যুক্তরাজ্যের সাতটি, বাংলাদেশের ছয়টি, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের চারটি সংগঠন। এ ছাড়া ফিনল্যান্ড, বসনিয়া, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, সুইডেন, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, জাপান, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের পরিবেশবাদী সংগঠন এতে সাক্ষর করেছে।
‘সরকার সুন্দরবনকে গুরুত্বহীনভাবে দেখ’: আনু মোহাম্মাদ
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক গ্রিন পিচ, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ, ভারতের কনজারভেশন ট্রাস্ট, ইন্টারন্যাশনাল রিভার্স ও ক্লাইমেট জাস্টিস প্ল্যাটফর্ম ওই আবেদনে সাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, গ্রিনম্যাগ, ইয়াং বাংলা সাইকেল নামের সংগঠন রয়েছে।
ওই আবেদন সম্পর্কে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সংগঠক শরীফ জামিল বলেন, ভারত যেখানে তার নিজ দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নজর দিচ্ছে। সেখানে দেশটি সুন্দরবনের পাশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দূষণকারী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। এই অন্যায় অনতিবিলম্বের বন্ধ করা উচিত।
এর আগে গেল এপ্রিলে ভারতের বন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনে বাঘের অবস্থা’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়- সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী কয়লা, ছাই, সার ও তেলবাহী একেকটি জাহাজ বাঘের জন্য ‘মোবাইল বম্ব’ (‘ভ্রাম্যমাণ বোমা)! বনের নদ-নদী দিয়ে এগুলো চলাচলের কারণে বাঘের নদী পারাপার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে বাঘের প্রকরণ (জিনগত বৈশিষ্ট্য) কমে গিয়ে অস্তিত্বের লড়াইয়ে বাঘ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ফলে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাণী বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব পরোক্ষভাবে হুমকির মুখে পড়ছে।
বাগেরহাটের রামপালে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বাড়বে। সেটাও একইভাবে বাঘের জিনগত বৈশিষ্ট্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজগুলোকে ‘ভ্রাম্যমাণ বোমা’ বলার ব্যাখ্যা হিসাবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের ভেতরে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস তেলবাহী একটি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। এতে সুন্দরবনের ক্ষতি হয়েছে। তা ছাড়া এরপর বনের ভেতরে ছাই ও কয়লাবাহী জাহাজডুবির ফলেও বনের ক্ষতি হয়েছে, যা বাঘের জন্য ক্ষতিকর।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় সুন্দরবনে বাঘের বসতি থাকা সম্ভব, এমন এলাকায় প্রতি ১০০ কিলোমিটারে চারটি করে বাঘ আছে। আর বাংলাদেশে সমপরিমাণ এলাকায় বাঘের সংখ্যা তিনটিরও কম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে যত বাঘ আছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ বাঘ এখানে বসতি করতে পারে। চোরা শিকারিদের উৎপাত, বাঘের খাবার কমে যাওয়াসহ নানা কারণে বাংলাদেশ অংশে বাঘের ঘনত্ব কম।
সুন্দরবনের বাঘের আচরণের পর্যবেক্ষণভিত্তিক তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের বাঘ নদীপথে ৬০০ মিটার পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারে। ভোর ৫টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বাঘগুলো নদীপথে চলাচল করে। আর সুন্দরবনের ভেতরের খাল দিয়ে জাহাজগুলো ওই সময়েই বেশি চলাচল করে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে জরিপ চলাকালীন শ্যালা নদী দিয়ে দিনে ২০০টি জাহাজ চলাচল করছিল।
বাঘ বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক না কেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবন ও বাঘের ক্ষতি হবে। এখন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের আশপাশে আরও শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। এতে সুন্দরবনের আশপাশে মানুষের অভিবাসন বেড়ে যাবে।
ফলে সুন্দরবনের ওপরে মানুষের নির্ভরশীলতা এবং ক্ষতি করার ক্ষমতাও বাড়বে। আমাদের উন্নয়ন দরকার, তা অবশ্যই সুন্দরবন রক্ষা করে তার পর।