কয়েক দফা আগুন লাগার পর বনজীবীদের পূর্ব সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে তাদের জীবিকা।
গত এক মাসের মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের বিভিন্ন এলাকায় চার দফা আগুনে প্রায় প্রায় পনেরো একর বনভূমি পুড়ে যায়। এতে বনের সুন্দরী, বলাসহ বিভিন্ন লতাগুল্ম ও গাছপালা পুড়ে যায়।
সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল সুন্দরবনে আগুন লাগার পর বনবিভাগ পুরো পূর্ব সুন্দরবন জুড়ে সতর্কতা জারি করে এবং বনজীবীদের বনে প্রবেশের পাশ-পারমিট সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে হঠাৎ করে আগুন দেওয়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাময়িকভাবে পাশ পারমিট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
“আমরা বনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করছি। এটা বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের ওপর চাপ কমবে এবং সুন্দরবনও সুরক্ষিত থাকবে।”
সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, মংলা ও রামপাল উপজেলার হাজারো মানুষ যুগ যুগ ধরে বনের মাছ, জ্বালানি কাঠ, গোলপাতা সংগ্রহ ও মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের রুস্তম ফরাজী বলেন, “সুন্দবনে যারা আগুন দিয়েছে তারা সংখ্যায় খুবই অল্প। এদের কারণে শরণখোলা উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ বিপাকে পড়েছেন।
“বনবিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের জীবিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।”
বনে যারা আগুন লাগিয়েছে তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচার করতে বনবিভাগের কাছে আহ্বান জানিয়েছে বলেন, “এদের কারণে আমাদের পেশার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের উত্তর রাজাপুর গ্রামের বাদল ফকির ও বজলু হাওলাদার জানান, বনবিভাগের কাছ থেকে পাশ নিয়ে সুন্দরবনে নদীখালে মাছ শিকার করে তা বাজারে বিক্রি করে কোনো মতে তারা সংসার চালান।
বাদল বলেন, “সুন্দরবনে আগুন লাগার কারণে হঠাৎ শুনি বনবিভাগ পাশ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
“এখন সুন্দরবনে যেতে না পারলে কী খেয়ে বাঁচব তা বুঝতে পারছি না।”
সুন্দরবনে আগুন দেওয়ায় গুটিকতক লোক জড়িত উল্লেখ করে স্থানীয় বনজীবী সগীর আকন বলেন, “বনবিভাগ যদি আমাদের বনে ঢুকতে না দেয় তাহলে আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।
তাদের প্রতিরোধে বনবিভাগকে সহযোগিতা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশের পাশ পারমিট পুনরায় চালুর দাবি জানান তিনি।
বনজীবীদের মতো আগুনদাতা দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় অল্প বলে জানান শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আকন।
কামাল বলেন, “গুটি কয়েক দুর্বৃত্তের কারণে সুন্দরবনের পাশ-পারমিট দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশ পারমিট বন্ধ করে দেওয়ায় বনের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে।”
সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন বলেন, “আমার ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বনে মাছ ধরে, গোলপাতা কেটে, মধু আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
“সম্প্রতি দুর্বৃত্তরা সুন্দরবনে আগুন দিয়ে [পরিস্থিতি] অশান্ত করে তুলেছে
তিনি জানান, আগুনের পর বন বিভাগে তাদের নিয়ে এলাকার বনজীবী ও স্থানীয়দের নিয়ে সচতেনতামূলক সভা করেছে। এসব সভায় জনগণের সম্পদ সুন্দরবন রক্ষা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব বোঝানো হয়ে থাকে।
আগুনদাতাদের ধরিয়ে দিতে বনমন্ত্রীর আহ্বান
সুন্দরবনে যারা আগুন দিয়েছে তাদের ধরিয়ে দিতে বন সংলগ্ন স্থানীয়দের আহ্বান জানিয়েছেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
রোববার (১ মে) দুপুরে শরণখোলা উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে বনবিভাগ আয়োজিত সুধী সমাবেশেরি বক্তব্যর সূত্র ধরে মন্ত্রী বলেন, আপনারা বলছেন তারা সংখ্যায় গুটিকয়েক। এরা এ এলাকার মানুষ। এদের আপনারা চেনেন জানেন।
তাই সুন্দরবন রক্ষার জন্য ওই অপরাধীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের দুটি রেঞ্জে বনজীবীদের পাশ-পারমিট বন্ধ থাকার প্রসঙ্গে বলেন তিনি, বনে বার বার আগুন লাগার কারণে তা বন্ধ রাখা রয়েছে।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তা আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহম্মদ অতুল মন্ডলের সভাপতিত্বে এই সুধী সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বাগেরহাট-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হোসেন, প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী, বনবিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. জহির উদ্দিন আহমেদ, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আকনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
এর আগে সকালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের তুলাতলায় আগুন লাগা এলাকা হেলিকপ্টারে করে পরিদর্শন করেন দক্ষিণাঞ্চল থেকে সাংসদ নির্বাচিত হওয়া এই মন্ত্রী।