২৭ মার্চ সন্ধ্যায় আগুন লাগে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের অন্যতম বিল এলাকা নাংলিতে। এর সতেরো দিন পর ১৩ এপ্রিল আবারও আগুন লাগে ফরেস্ট ক্যাম্প এলাকার পঁচাকোড়ালিয়া, নাপিতখালী ও আব্দুল্লাহ’র ছিলা এলাকায়।
এনিয়ে গেল ১৪ বছরে সুন্দরবনে আগুন লেগেছে অন্তত ২০ বার। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই অভিযোগ ওঠে আগুন লাগানোর। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তবে সুন্দরবনে বছর বছর অগ্নিকান্ডের ঘটনা থামেনা।
স্থানীয় ও পরিবেশবাদীদের দাবি, এক শ্রেণীর অসাধু বন কর্মকর্তা ও তাদের স্থানীয় দালাদদের সহযোগীতায় ইচ্ছাকৃত ভাবে আগুন লাগানো হয় সুন্দরবনে। সরেজমিন অনুসন্ধানেও মিলেছে একই ধরনের অভিযোগ।
নাংলির শিকদার বাড়ির ছিলায় ২৭ মার্চ দুপুরের দিকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে ধারণা স্থানীয়দের। তবে ঘটনাটি বন কর্মীদের নজরে আসে ওই দিন সন্ধ্যার পর। এলাকাটি সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তর্গত ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্পের কাছে।
নাংলি এলাকায় এর আগে ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ, ২০০৬ সালের ১ মে, ২০০৭ সালে ১৯ মার্চ ও ২০১১ সালের পহেলা মার্চ মোট চার বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সব মিলে ৫ বার পুড়ল বনে এই এলাকা। ফলে ভোলা নদী সংলগ্ন সুন্দরবনের এই অংশে বড় গাছপালা ও জীববৈচিত্রও তেমন চোখে পড়ে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এক শ্রেণী অসাধু বন কর্মকর্তারা বর্ষা মৌসুমে বনের নাংলি এলাকায় অবৈধভাবে মাছ শিকারের জন্য ইজারা দেয়। বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তারাই পরিপল্পিতভাবে আগুন লাগায় বনে। আগুনে বন পুড়ে পরিস্কার হলে সহজে মাছ ধরতে পারে ইজারা নেওয়া ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয়রা জানান, নাংলি সুন্দরবনের বিল এলাকা। বনের অন্য এলাকা থেকে একটু উঁচুও। সাভাবিক জোয়ার ভাটার পানি ওঠেনা এখানে। শুক্ন মৌসুমে তাই শুস্ক থাকে বনের এই অংশ। তবে বর্ষায় পানিতে টৈটুম্বর থাকলে নাংলি এলাকা।
বর্ষায় পানি বাড়ার সাথে সাথে এখানে পাওয় যায় কৈ, শিং, মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশিয় মাছ। তবে বনাঞ্চল হওয়ায় সারা বছরই বিভিন্ন গাছের পাতা, ডাল ও অন্যান্য লতাগগুল্ম জমে থাকে এখানে। তাই মাছ শিকার বেশ কঠিন হয়। মূলত বর্ষায় মাছ ধরার সুবিধার জন্যই লোকালয় সংলগ্ন এ বনে আগুন দেওয়া হয়।
সুন্দরবনের নাংলি সংলগ্ন সবচেয়ে কাছের লোকালয় বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর ভোলার পাড় গ্রাম। এক সময়ের ভোলা নদীর অংশ চর পড়ে বসতি হয়েছে। তাই নাম হয়েছে ভোলার পাড়। পলি জড়ে গড়া গ্রামের ছেলে-বুড়ো প্রায় সব বাসিন্দই জানেন নদীর পর পারের বন বর্ষা মৌমুমে ইজারা দেওয়া হয় মাছ ধরার জন্য। তবে এ নিয়ে কেউ কথা বলতে রাজি না প্রকাশে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে কথা বললে রাজি হন স্থানীয় এক কিশোর। তিনি বলেন, “আপনারা তো না কারণ খুঁজেন। আগুন কেন লাগে আমি কই। আগুন দেয়া হয়। এহানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে যায়, আর কৈ, শিং, মাগুর ভালো পাওয়া যায়।”
দশম শ্রেণী পড়ুয়া ওই তরুণ আরও জানান, সারা বছর গ্রামের মানুষ গরু চরাতে যায় বনের ওপারে। কেবল বর্ষাকালে বনের ওই এলাকায় তারা প্রবেশের অনুমতি পায় না। শুধু মাত্র বন বিভাগকে টাকা দিয়ে ইজারা নিয়ে একটি চক্র তখন মাছ ধরে। তারাই বছর বছর আগুন দেয়।
অবশ্য আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করাতে মাছের উৎপাদন বেশি পাওয়ার কোন যোক্তিক্তা নেই বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন ওয়ার্ড ফিস বাংলাদেশের রিসার্স অ্যাসিস্ট্যান্ট বল রাম মহল।
তবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে স্থানীয় ভাবে প্রচলিত আছে কৈ, শিং জাতীয় মাছ শুকè মৌমুমে চালা করে (গর্তে) মাটির ভেতর থাকে। বর্ষা মৌসুমে বিল এলাকা গুলো পানি ভরে গেলে আবাবাও মাছ পাওয়া যায় বলে প্রচলিত আছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মংলা-বাগেরহাট অঞ্চলের সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ বলেন, আগ্নি দুর্ঘটনার পর আমি নিজে ঘটনাস্থলে গেছি। আমার মনে হয় এটি পরিকল্পিত ভাবে আগুন লাগানেরা ঘটনা।
প্রায় প্রতিবছরই সুন্দরবনের এই এলাকায় আগুন লাগে। স্থানীয়রা এক প্রকার সেচ্ছাই আমাদের বলেছে, বর্ষা মৌসুমে টেংরা, কৌ, বোয়াল প্রভৃতি মাছ ধরার জন্য অবৈধ ইজারাদাররা পরিকল্পিতভাবে বনের এই অংশে আগুন দেয়। এতে দুই দিকেই লাভ বান হয় অসাধু বন কর্মকর্তারা। একদিকে দালালদের কাছ থেকে বেশি মূল্য পায়। অন্যদিকে আগুন নেভানোর নামে সরকারি অর্থ লোপাট হয়।
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা তো নিজেরাই গেছেন ওই এলাকায়। আগুন লাগার ওই এলাকা কোন খাল বা ঘের নয় যে ইজারা দেওয়া হবে। বনের ভেতরে কোন ইজারা দেওয়ার সুযোগ নাই। কে ওখানে ইজারা দিবে।’
‘অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। যদি এ ধরণের কোন কারণ জানা যায় অবশই কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে ভোলা নদীর ওপারে বনে সংলগ্ন লোকালয় হওয়ায় স্থানীয় জনগণের অবাধ বিচরণ সুন্দরবনের জন্য হুমকি এবং তারাই আগুন লাগার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ডিএফও সাইদুল ইসলামসহ খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) জহির উদ্দিন আহম্মেদের।
| ইনজামামুল হক, সুন্দরবন থেকে ফিরে।
** নিভেছে সুন্দরবনের আগুন, তদন্ত কাজ শুরু
** সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে, তদন্তে কমিটি
** সুন্দরবনে ফের অগ্নিকান্ড
** তবে কি গাছ কেটে বনে আগুন !
** ‘সুন্দরবন আমার মায়ের মতো’