আগুন, খুব প্রযোজনীয় হলেও কখনো কখনো আবার ভয়ানোক বিনাশী। বিজ্ঞানের ভাষায়, আগুন (Fire) হলো দ্রুত প্রজ্জ্বলনশীল পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া। আর এই বিক্রিয়ায় প্রয়োজন হয় অক্সিজেন, (শুক্ন) দাহ্য বস্তু অর্থাৎ জ্বালানী এবং দাহ্য পদার্থ বা তাপ।
শুক্ন মৌসুমে এই তিনের আধিক্যই থাকে সুন্দরবনে। তবে তাই বলে বছর বছর আগুনে পোড়া কী সুন্দরবনের নিয়তি! নিশ্চই না।
তবে, প্রশ্ন আসবে বনাঞ্চল হিসাবে সুন্দরবনেই কি এক মাত্র, যেখানে – অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। নিশ্চতই তা নয়। বিশ্বের অনেক ছোট বড় বনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ক্ষয়ক্ষতিও হয় ব্যাপক। যা পরিচিত দাবানল (wildfire) হিসাবে।
মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া বলছে, বনভূমি বা গ্রামীণ এলাকার বনাঞ্চলে সংঘটিত একটি অনিয়ন্ত্রিত আগুন হলো দাবানল। সংঙ্গাগত দিক থেকে মিল থাকলেও সুন্দরবনের অগ্নিকান্ড কোন ভাবেই দাবালল নয় বল মনে করে বন বিভাগ ও সংশ্নিষ্টরা। কারণ ওই সব এলাকার গড় তাপমাত্রা থাকে ৪০ ডিগ্রীর ওপরে। কিন্তু সুন্দরবনে তাপমাত্র থাকে এর বেশ নিচে।
বন বিভাগ ও সংশ্নিষ্টদের মতে, বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন অঞ্চল সুন্দরবনে আগুন লাগার প্রধান কারণ মৌয়ালদের (মধু সংগ্রহকারী) ফেলে যাওয়া আগুন অথবা জেলে, বনজীবিদের ফেলা বিড়ি-বিগারেট বা রান্নার আগুন। এ ধরনের কোন কারনে অগ্নিকান্ডের ঘটলে তা নিছক দুর্ঘটনা।
তবে সব সময়ই একটা প্রশ্ন থেকে যায় সুন্দরবনে কি আগুন লাগানো হয়েছে?
গেল ১৪ বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২০টি। সব শেষ রোববার আগুন লাগে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে অন্যতম শুষ্ক বিল এলাকা নাংলিতে।
বন বিভাগের পক্ষ থেকে রোববার (২৭ মার্চ) সন্ধ্যায় আগুন লাগার কথা বলা হলেও স্থানীয়দের ধারনা ওই দিন দুপুরের পর পর চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তর্গত ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্পের কাছে আগুনের সূত্রপাত হয়।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ বনাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, খুব বড় কোন গাছপালার সম্ভার নেই পুড়ে যাওয়া বনের আশপাশেও। ভোলা নদীর পাড় থেকে বনের গহীনে প্রায় তিন কিলোমিটার পায়ে হেটে চোখো পড়েছে মাত্র একটি সুন্দরী গাছ। গেওয়া, কেওড়া বা সুন্দরবনের অন্য পরিচিত গাছপালাও হাতে গোনা। প্রধানত লতাগুল্মেই ভরা নাংলি ফরেস্ট এলাকা। বনের মাঝে পায়ে হেটে চলাচলের অসংখ্য পথ।
লোকালয়ের একদম কাছে হওয়ায় মানুষের যাতায়েত যে খুব বেশি তা বেশ স্পষ্ট। সঙ্গে থাকা কয়েক তরুণ অবশ্য শুধু যাতায়েত নয় বললেন, এখানে তারা গরু চরাতে নিয়ে আসেন। সারাদিনই প্রায় নাংলি এলাকায় তাকে তাদের গরু-মহিষ। সন্ধ্যার আগে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। রান্নার জন্য এখান থেকে জ্বালানী কাঠও সংগ্রহে কথাও জানায় কয়েক জন।
এসব তথ্য জানান পর গাছ কেটে নিয়ে বন আগুন লাগানো হতে পারে এমন সন্ধ্যেহ বাড়তে থাকে সবার মাঝেই। আগুনে পুড়ে যাওয়া বনের মাঝে একটু দুুরে দুরেই দেখা মেলে কেটে নেওয়া গাছের পুড়ে যাওয়া মূল (মূথা-স্থানীয় ভাষায়)।
বনের ভেতর আরও বেশ কিছু দুর এগোতে দেখা মেলে সদ্য কেটে নেওয়া একটি গাছের মূল। বনের ভেরত অসংখ্য পায়ে হাটা গলি পথের একটি দিয়ে ফেরার পথে বনের আগুনে পুড়ে যাওয়া অংশের প্রায় সোয়া কিলোমিটার দুরে সদ্য কেটে নেওয়া একটি গাছের মুথা দেখা যায়।
এসব দেখে স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিলো তবে কি গাছ কেটে নিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে বনে। সঙ্গে থাকা বন বিভাগের ধানসাগর স্টেশনের এক জন শ্রমিক বলেন, ‘কি আর বলবো, আমি তো দেখি নি আগুন দিছে না লাগছে। আমরা কাজ করি, আমরা জানি না কি করে আগুন লাগছে।’
একটু দম নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোন কাজে লাগলে বন বিভাগ ডাহে। আমারা টাকার বিনিময় কাজ করি। মেয়ে মানুষের সংসার- বোঝেন তো, বাপের বাড়িও দেখতে হয় আবার ভাতারের (স্বামীর) বাড়িও দেখতে হয়।’
বন সংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর ভোলার পাড় গ্রামের ওই শ্রমিকের কাথায় আগুন লাগার কারণ আরও রহস্য ময় হয়েই রইল।
তবে বন বিভাগ মনে করছে, গবাধি পশু আনতে গিয়ে স্থানীয়দের ফেলে আসা বিড়ি সিড়ারেটের আগুন থেকে অগ্নিকান্ড ঘটে থাকতে পারে। ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছে তারা।
কমিটির প্রধান সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. বেলায়েত হোসেন গাছ কেটে নিয়ে বনে আগুন দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ অস্বিকার করেছেন। তিনি বলেন, এখানে বড় তেমন কোন গাছ নেই। মূলত এই এলাকা ‘বলা’ গাছ জন্মায়। জ্বালানী হিসাবেও এর তেমন চাহিদা নেই।
|| ইনজামামুল হক, সুন্দরবন থেকে ফিরে।
** ‘সুন্দরবন আমার মায়ের মতো’
** সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে, তদন্তে কমিটি
** সুন্দরবনের নাংলি ক্যাম্প সংলগ্ন বনে আগুন