বাগেরহাটের দুই উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। কারণ, মোল্লাহাট ও চিতলমারী উপজেলার ১৩টি ইউপির সব কটিতেই কেবল আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তাঁদের বাইরে আর কেউ প্রার্থী হননি।
অন্য উপজেলার যেসব ইউনিয়নে বিএনপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী আছেন, সেখানেও তাঁরা এলাকাছাড়া বা অনেকটা চুপচাপ। বাগেরহাট সদর উপজেলার ১০টি ইউপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে মাত্র একটিতে। এই অবস্থায় জেলার আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার পথে।
‘জান বাঁচানো ও এলাকাছাড়া’ হওয়ার ভয়ে বিএনপিসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অনেকের প্রার্থী না হওয়া এবং প্রত্যাহার করে নেওয়ার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নিকট অতীতে এ জেলার একটি ইউনিয়নেও চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার নজির নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার এ হিড়িকে এখনই অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে আসন্ন ২২ মার্চের ভোটের রং।
বাগেরহাটে প্রথম ধাপে ভোট হচ্ছে ৭৪টি ইউপিতে। এর মধ্যে ৩৪টিতে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী। এর মধ্যে ১৯টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বাইরে কেউ মনোনয়নই জমা দেননি। যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়েন সাতটি ইউপির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। আর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে আট ইউপিতে।
সর্বশেষ ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে বিএনপির ১২ জন ও জামায়াতের দুজন জয়ী হয়েছিলেন। এর মধ্যে বিএনপির চারজন এবার প্রার্থী হয়েছেন। একজন মারা গেছেন। বাকিরা মনোনয়নপত্র জমা দেননি বা প্রত্যাহার করেছেন বা করতে বাদ্ধ হয়েছেন।
বাগেরহাটে কেন এ অবস্থা?
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রার্থী ও সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের এ হালের পেছনে বেশ কিছু কারণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বাগেরহাট-১ আসনের (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) সাংসদ শেখ হেলাল উদ্দিনের ‘সম্মান রক্ষা’।
এ তিন উপজেলাসহ জেলার সর্বত্রই তাঁর নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া রয়েছে প্রতিপক্ষ সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বলে পয়সা খরচ না করে চেয়ারম্যান হওয়ার খায়েশ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও এ তিন উপজেলায় হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতেন। কিন্তু নেতাকে খুশি করতে গিয়ে অতি উত্সাহী হয়ে কাউকেই প্রার্থী হতে দেননি স্থানীয় নেতারা। এর প্রভাব পড়েছে অন্য উপজেলাগুলোতেও।
বাগেরহাট সদরের কাড়াপাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ বশিরুল ইসলাম। পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতিও তিনি। এখানে বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই। কিন্তু জামায়াতের প্রার্থী মানজুরুল হক রাহাত কারাগারে থেকেই মনোনয়নপত্র জমা দেন। গত বুধবার (২ মার্চ) মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন একটি মামলায় শুনানির জন্য রাহাতকে আদালতে আনা হয়। এজলাসে তোলার আগে বশিরুল তাঁকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে রাজি করাতে সক্ষম হন।
জানতে চাইলে বশিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এলাকায় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিপক্ষ জামায়াতের প্রার্থী দাঁড়ালে দু-একটা ঘটনা ঘটতে পারত। জামায়াতের প্রার্থীর কর্মীসহ আমি তাদের বুঝিয়েছি। এরপর প্রত্যাহার করেছে। এতে ইতিবাচক দিক হচ্ছে শান্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর টাকা খরচও কিছুটা বেঁচে গেল।’
বাগেরহাট সদরের একমাত্র ষাটগম্বুজ ইউনিয়নে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থেকে গেছেন তৌহিদুল ইসলাম ফকির। কিন্তু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকে তিনি এলাকায় নেই। তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ।
বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের শেখ আখতারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, ‘আমি জিতব এটা নিশ্চিত। এই জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে বসানোর চেষ্টা করি নাই। এখন আমার মতো গরিবের কিছু টাকা খরচ হবে এই আরকি।’
মাঠের আরও চিত্র:
গত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন—এমন ইউপিতেও এবার বিএনপির প্রার্থী নেই। সদরের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ হাওলাদার। এবার দলের মনোনয়নের জন্য ফরম নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের চাপে দল থেকে মনোনয়নপত্র না দেওয়ার জন্য জেলা ও উপজেলা নেতাদের কাছে তদবির করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর নাম প্রস্তাব করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে তড়িঘড়ি করে শরাফত হোসেন নামে এক নতুন প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।
কিন্তু শরাফতের অভিযোগ, তাঁকে মনোনয়নপত্র জমা না দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। প্রতিনিধি দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে কেড়ে দেওয়া হয়। এখন শরাফত এলাকায় খুব একটা থাকছেন না।
‘আপনার নামে তো কোনো মামলা নেই। তাহলে ভয় কিসের’—এমন প্রশ্ন করা হলে শরাফত বলেন, ‘জানের ভয় আছে না?’
বারুইপাড়া ইউনিয়নের সর্বশেষ চেয়ারম্যান ছিলেন বিএনপির শেখ শওকত হোসেন। কয়েক মাস আগে তিনি মারা যান। এবার এখানে বিএনপি প্রার্থী করেছিল সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বিশ্বাসকে। তিনি মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরই দুই দফা রাতে তাঁর বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। প্রতিপক্ষও চাপ দিতে থাকে। পরে প্রত্যাহার করে নেন।
জানতে চাইলে নিয়ামত আলী বলেন, ‘চাপে থাকতে পারি নাই। কার চাপে এটা জানতে চাইয়েন না। তাহলে জানে বাঁচব না।’
মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে প্রত্যাহার করে নেওয়া এক প্রার্থী বলেন, সদ্যসমাপ্ত বাগেরহাট পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় মিনা হাসিবুল হাসান এখন কারাগারে। এখন ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী হলে ‘জানে মেরে ফেলবে’। আর সামনে তো বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসবে সে রকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে এলাকায় কর্ম করে খেতে হবে না?
নেতারা কী বলছেন:
জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালাম দেশের বাইরে। যোগাযোগ করা হলে তিনি কাছে দাবি করেন, তাঁর দলের অনেকের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ছিনতাই করা হয়েছে। পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। চিতলমারী ও মোল্লাহাটে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বাচন কার্যালয় ঘেরাও করে রেখেছিলেন, যাতে কেউ জমা না দিতে পারেন।
মামলা বা জিডি করা হলো না কেন জানতে চাইলে এম এ সালাম বলেন, দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা চলছে। আসামি হাজার হাজার। মামলা বা জিডি করতে গেলে উল্টো ধরে ফেলে।
দলে কোন্দলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে ঢাকায় থেকে সরকার দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দলের লোকদের কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছেন। এঁরাই দলে কোন্দল দেখেন।’
অবশ্য জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম খান অভিযোগ করলেন, দলীয় প্রার্থী না থাকার মূল কারণ জেলা নেতৃত্বের অযোগ্যতা। জেলা সভাপতি পকেট কমিটি করেছেন সব স্থানে। সবাই সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুজ্জামান বলেন, ‘মামলা দিয়ে, ঠ্যাং ভেঙে, মারধর করে কিংবা ধরে এনে কাউকে প্রার্থী না হওয়ার কথা বলা হয়েছে এমন একটা উদাহরণও কেউ দিতে পারবে না।’
‘আসলে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। বিএনপি পরাজিত শক্তি হিসেবে হারিয়ে গেছে। ইউপিতে আমাদের নেতা-কর্মীরা মুভ করার পর তারা মাঠ ছেড়ে দিয়েছে।’