প্রভাত ফেরি শেষ না হতেই বাগেরহাটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ফুল লুট হয়ে গেছে।
ভাষা শহীদের স্মরণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহর থেকে সকাল পর্যন্ত সর্বস্থরের মানুষ শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায়। এসময় শিশু কিশোরদের পদচারণায় মুখর ছিলো পুুরো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। কেউ ব্যস্ত ছিলো ফুল দিতে, কেউ নিচে দাড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন ফুলের সমাহার।
এরই মাঝে রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে একদল উশৃঙ্খল মাত্র কয়েক মিনিটে শহীদ বেদী থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলীর সব ফুল লুটে নেয়। জুতা-স্যান্ডেল পায়ে শহীদ বেদীতে উঠে ফুলের পাশাপাশি বাংলা ভাষার বর্ণমালা গুলোও ভেঙে নিয়ে যায় তারা। শতশত মানুষের উপস্থিতিতেই মাত্র কয়েক মিনিটে জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পরিনত হয় একটি ময়লার স্তুপে।
এর ফলে সকাল ১০টা বা তার পর শহীদ মিনারে ফুলের শ্রদ্ধা জানাতে আসা শিশু-কিশোর ও অভিভাবক হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।
ছোট্ট শিশু সন্তানকে নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহীদ মিনারে এসে এমন দৃশ্য দেখে ক্ষোভ জানান শহরের সরই এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম।
বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত শহীদ মিনার প্রাঙ্গনের ছিলাম। মাইকে বার বার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো, কেই শহীদ মিনার থেকে একটি ফুলও নিবেনা। একুশ তারিখ রাতেও শহীদ মিনারে ফুল থাকবে প্রশাসন পাহারা দিবে।
কিন্তু এটা কী হলো? অন্যান বছর বেলা ১২টা পর্যন্ত ফুল থাকে এবার কঠোর ঘোষণার পর সকাল ১০টা পেরোনোর আগেই শহীদ মিনারের ফুল লুট হয়ে এলো!
‘একুশের ভোর মূলত শিশু-কিশোরদের মিলনমেলায় পরিনত হয়। মা-বাবার হাত ধরে শহীদ মিনারে তারা শুধু ফুল দিতেই আসেনা, তারা দেখে ভাষার জন্য, ভাষা শহীদদের জন্য মানুষের ভালোবাসা কত বেশী হতে পারে। দীক্ষা নেয় ভবিষ্যত বাংলা ভাষার ধারক ও বাহকের’ বেদীর ফুল লুট হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে শহীদ মিনার চত্বরে দাড়িয়ে কথা গুলো বলছিলেন মোহাম্মদ আলী।
সরকারি চাকুরিজীবি মোহাম্মদ আলী বলছিলেন – আমারা যতটা না আন্তরিক ভাষার আনুষ্ঠানিকতা পালনে, কেন জানি ততটাই উদাসীন মাতৃভাষার চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করতে। ভাষার প্রতি ভালোবাসা আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজাল মুক্ত করে হৃদয়ে ধারণ করেতে না পারলে এই অবস্থার পরিবর্তন সম্বব নয়।
প্রত্যক্ষদর্শী বাগেরহাট রুদ্রনাট্য দলের নাট্যকর্মী আরিফুল ইসলাম সজিব বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারির ভোর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শতশত সাধারণ মানুষ জড়ো হয়ে শহীদ বেদীতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। এটা চলে প্রায় সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। এটা শেষ না হতেই দেখলাম বিভিন্ন বয়সের শিশু কিশোর ও যুবক হঠাৎ শহীদ মিনারের বক্ষে উঠে যে যার মতো ফুল নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ফুল নিতে কেউ বাধা পর্যন্ত দিল না। চার পাশে পুলিশের লোক থাকলেও তাদের কোন চেষ্টা ছিলোনা এই হঠকারীতা বন্ধে।
হাসতে হাসতে মাত্র চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে শহীদ মিনার একেবারে ফুল শুন্য করে নিয়ে চলে যায়।
এর আগে শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা থেকে বভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের ঢল নামে বাগেরহাট শহীদ মিনারে। একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টায় বাজতেই জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংষ্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধা জানায়া শহীদ বেদীতে ।
এদিকে, প্রকাশ্য দিবালোকে জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ফুল লুট করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংষ্কৃতিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষ।
সিপিবি’র জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ফররুখ হাসান জুয়েল বলেন, যাদের জীবনের বিনিময়ে আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি। তাদের আমরা বছরে একটি দিন স্মরণ করে থাকি। তাদের স্মরণ করতে প্রথম প্রহর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত আমরা তাদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই।
অথচ এবছর একদল অল্প বয়সী শিশু কিশোর জড়ো হয়ে প্রকাশ্যে শহীদ বেদিতে স্যান্ডেল-জুতা পায়ে দিয়ে তার ওপর উঠে নির্বিঘে্ন সব ফুল লুট করে নিয়ে গেলো। তারা কাদের উষ্কানিতে এমন অসভ্য আচরণ করলো তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। এদের যদি এখনি না থামানো যায় তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম এদের কাছ থেকে কি শিক্ষা পাবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইউনাইটেড কমিউনিস্টলীগের জেলা সভাপতি রণজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষ না হতেই শহীদ বেদির ফুল লুট এটা ভবিষ্যতের জন্য কিসের আলামত বহণ করছে। এই ঘৃণ্য কাজ যারা করলো তারা কি ভবিষ্যতের রাজাকার আলবদরদের উত্তরসূরী। এখনই এদের টুটী চেপে ধরতে প্রশাসনের কাছে দাবী জানান তিনি।
জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালাম বলেন, ভাষা শহীদদের স্মরণের দিনটি শেষ না হতেই এভাবে শহীদ বেদী থেকে ফুল নিয়ে যাওয়া জগন্য কাজ। এরা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এই কাজ যারা করেছে তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন তিনি।
বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন, শহীদ বেদীর ফুল যারা নিয়েছে তাদের বাবা- মা তাদের কি শিক্ষা দিয়েছে। এদের বাবা মা কোন আদর্শে এদের মানুষ করছে তা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এখন এদের শিক্ষা না দেয়া গেলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আরও ভয়ঙ্কর কাজ করবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাংগীর আলম বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কর্মসূচি শেষ না হতেই শহীদ মিনারের ফুল নিয়ে যাওয়া নিষ্কৃষ্ট কাজ।