মাকে পূজা করার মাধ্যমে দিন শুরু হতো বীরেনের। এরপর মাকে গোসল করিয়ে, খাইয়ে দিয়ে নিজে দিনের প্রথম আহার মুখে তুলতেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে এভাবেই চলছিল।
তবে সোমবার (৭ ডিসেম্বর) প্রথম সেই নিয়মে ব্যতিক্রম হয়েছে। কারণ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আগের দিন সন্ধ্যায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন মা ঊষা রানী মজুমদার।
নিয়তির অমোঘ টানে ছিন্ন হলো মা-ছেলের বন্ধন। তবে মাকে হারালেও ভেঙে পড়েননি বীরেন। তাঁর বিশ্বাস, দেহত্যাগ করলেও মা তাঁর সঙ্গেই থাকবেন। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও নিজে হাতে সেরেছেন তিনি।
মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকেই ঘরের সামনেই মায়ের শেষকৃত্যের আয়োজন করেন বীরেন।
পরিবারের সদস্যদের দাবি, মৃত্যুর সময় উষা রানীর বয়স হয়েছিল ১১৩ বছর। বীরেনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আরতী রানী সোমবার বলেন, ‘হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল শাশুড়ি মার। মোটরসাইকেলে করে শহরের ডাক্তারও নিয়ে এসেছিলেন বীরেন। কিন্তু মাকে আর বাঁচানো গেল না।’
উষা রানীর বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামে। ১৯ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই হাঁটাচলা করতে পারতেন না তিনি। আর বাবার মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই মায়ের দেখাশোনা করতেন বীরেন।
তাঁর পুরো নাম বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার। বয়স ৫৪-তে পড়েছে। মায়ের সেবায় ত্রুটি হতে পারে—এই দুশ্চিন্তা থেকে বিয়েই করেননি তিনি। মাকে নিয়েই সংসার পেতেছিলেন পেশায় দিনমজুর বীরেন। যা আয় হতো তা দিয়ে চলে যেত দুজনের সংসার। তবে ইদানীং মা উষা রানীর শরীরটা আর চলছিল না। বয়সের ভারে একেবারে নুয়ে পড়েছিলেন। শরীরে ভর করেছিল বার্ধক্যজনিত নানা রোগ।
মাসে একবার পার্শবর্তি পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা সদরে ডাক্তারের কাছে যেতে হতো। হাঁটাচলার সামর্থ্য ছিল না তাঁর। তবে এ নিয়ে তাঁকে কোনো চিন্তা করতে হয়নি। কারণ ছেলে বীরেন ছায়া হয়ে আগলে রাখতেন তাঁকে। মাকে বাঁশের ডালায় বসিয়ে সেই ডালা মাথায় তুলে হেঁটে হেঁটে সাত মাইল দূরে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন বীরেন।
এই দীর্ঘ পথে ভাঙা রাস্তা, বাঁশের সাঁকো মাড়িয়ে যেতে হতো তাঁকে। আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ ওই পথে যানবাহন চলত না। যেতে যেতে পথে থেমে থেমে বীরেন মাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘ও মা, তোমার কি কষ্ট অয়? কষ্ট অইলে ডালাটা শক্ত কইরা ধরো।’ বীরেনের মাতৃভক্তি দেখে সবাই মুগ্ধ হতো।
প্রতিবেশীরা জানায়, বাড়িতে বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় বীরেন বাইরে গিয়ে কখনো বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়া গায়ে লাগাতেন না। কারণ তাঁর মা তো আর ওই পাখার হাওয়ায় বসতে পারবেন না। শীতের মৌসুমে কোনো বিশেষ কাজে ঘরের বাইরে থাকলে কখনোই রাতে ঘুমানোর সময় বীরেন লেপ-কাঁথা গায়ে দিতেন না।
বলতেন, ‘আমি গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আরামে ঘুমালাম, আর মায়ের গায়ে যদি কাঁথা না থাকে তাহলে আমি কী জবাব দেব?’ গত বছর মা দিবসে বীরেন ও তাঁর মাতৃভক্তি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘মাকে মাথায় রাখেন বীরেন’ শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায়ই লোকজন আসত বীরন ও তাঁর মাকে দেখার জন্য। অনেকে মোবাইলে ফোন করে খোঁজখবর নিতেন। অনেকে মাসহ বীরেনকে বেড়িয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
বীরেনও চেয়েছিলেন মাকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন। তবে মা চলে যাওয়ায় সেই আশা অপূর্ণই রয়ে গেল। গতকাল সোমবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে বীরনদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা আহাজারি করছে। প্রতিবেশীরা বলাবলি করছিল, এখন কী হবে বীরেনের। মাকে হারানোর পর কী নিয়ে বাঁচবেন তিনি। তবে বীরেন কাঁদেননি। তিনি শুধু বলছিলেন, ‘আমার মা মরে নাই। মায়ের কখনো মৃত্যু হয় না।’
মায়ের সৎরের জন্য নিজ হাতে সব আয়োজন করেছেন বীরেন। প্রতিবেশী, সাংবাদিক, গ্রামবাসী ভিড় করেছিল বীরেনদের বাড়ির আঙিনায়। বীরেন সবাইকে জানিয়ে দেন, শ্মশানে নয়, ঘরের সামনেই সত্কার করা হবে মাকে।
দুপুর ১২টার দিকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিবারের সদস্যরা জানায়, মৃত্যুর আগে বীরেনকে আশীর্বাদ করে গেছেন মা। বলে গেছেন, ‘চিন্তা করিস না বাবা, তোর সব কাজে জয় হবে।’
সকালে বীরেনের বড় ভাই শ্যামলাল মজুমদারকে দেখা গেল আঙিনার চারপাশে ঘুরছেন আর বিলাপ করে কাঁদছেন। মাঝে মাঝে বীরেনকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘ভাই, তুই একটু চিত্কার কইরা কাঁদ, মনডারে হালকা কর।’
প্রতিবেশীরা জানায়, মাকে গোসল করানো, কাপড় ধুয়ে দেওয়া, খাওয়ানো, চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ে দেওয়া, ডাক্তার দেখানো—সবই করতেন বীরেন। মায়ের প্রতি বীরেনের শ্রদ্ধার তুলনা ছিল না। কোথাও কাজে গেলে এক ফাঁকে বাড়িতে এসে মাকে দেখে যেতেন তিনি। মাকে না খাইয়ে মুখে খাবার তুলেছেন বীরেন—এ দৃশ্য কেউ কখনো দেখেনি। ভাঙা ঘর বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেলেও মায়ের শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে দিতেন না বীরেন। পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে মায়ের পাশে বসে নির্ঘুম রাত কাটাতেন তিনি।
বড় ভাই শ্যামলাল বলেন, ‘কেউ বীরেনের কথা জিজ্ঞেস করলে আমরা এত দিন বলতাম, ও মায়ের সেবা করে। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর এখন ও কী নিয়ে বাঁচবে? আমার ভাইটার কী হবে?’
সোর্স – কালের কন্ঠ (শিরিনা আফরোজ, পিরোজপুর)।