ইনজামামুল হক, সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলা থেকে ফিরে । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
১৫ নভেম্বর, উপকূলে আঘাত হানে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সিডর। প্রাণ হারান কয়েক হাজার মানুষ। যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তারা হারান সর্বস্ব।
বিপন্ন উপকূলের লাখো মানুষের পাশে দাঁড়াতে সারাদেশের পাশাপাশি হাত বাড়ায় বিশ্ব সম্প্রদায়ও। আসে ত্রান, আসে আশ্বাস। নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বাঁধেন বিধ্বস্ত উপকূলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। দেশি-বিদেশি ত্রান সহায়তা কাজে লাগিয়ে অসম্ভব প্রাণশক্তির অধিকারি মানুষগুলো আবারও শুরু করেন জীবন সংগ্রাম।
উপকূলে সংগ্রামী মানুষ গুলোর বেঁচে থাকার এমন যুদ্ধ এটাই প্রথম নয়। বছর বছর ঝড়-ঝঞ্জার সাথেই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা তাদের জীবণেরই অংশ।
তবে সিডরের পর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলো একটু নতুন করেই ভেবে ছিলেন ভাগ্য বদলের কথা। কারণ আগেও ঝড় দেখেছেন, মৃত্যুও দেখেছেন তারা। কিন্তু এভাবে ঝাপিয়ে পড়ে মানুষের জন্য পাশে দাড়াতে খুব কমই দেখেছেন প্রান্তিক এই মানুষগুলো।
সিডরের পর প্রায় আড়াই বছর চলেছে সরাসরি ত্রান কার্যক্রম। তাই অনেকেই ভেবেছিলেন হয়তো এর অংশ হিসাবে এলাকায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও কাজ করবে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলো। তবে তেমন কিছুই হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কিংবা তাদের ঘুরে দাঁড়াতে গৃহিত প্রকল্পের সুফল মিলেছে সামান্যই। অধিকাংশ মানুষকে সাহায্য-নির্ভর করা হয়েছে। কর্মক্ষম মানুষগুলোকে অলস করে দেওয়া হয়েছে। বহু মানুষ সিডরের পর এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তাদের কর্মসংস্থানেও কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই।
গত ক’বছরে সিডর বিধ্বস্ত জনপদ গুলো থেকে কি পরিমান লোক কাজের খোঁজে, নিরাপত্তা বা অনান্য কারনে এলাকা ছেড়েছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে সরেজমিন সিডর উপদ্রুত এলাকার ঘুরে এবং মানুষের সাথে কথা বলে কর্মসংস্থানের অভাবে লোকজন অন্যত্র চলে যাওয়ার একটি বড় ধরনের হার লক্ষ্য করা গেছে।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মো. জাকির হোসেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সিডরের পর অনেক ত্রান এসেছে এই এলাকায়। কিন্তু কোন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি। কাজ না থাকায় ঢাকা, চিটাগাং, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজের জন্য এই অঞ্চল থেকে লোক জন যাচ্ছে।
উত্তর সাউথখালী গ্রামের লিয়াকত মোল্লা জানান, এখান থেকে কাজে জন্য যাওয়া মানুষের একটি বড় অংশ চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে যায়। মেয়েরা বিশেষ করে গার্মেন্টসে কাজের জন্য চট্রগ্রাম যায়। আর পুরুষ লোক গাছ কাটতে ও অন্যন্য কাজে সিলেটে যায়।
রায়েন্দা গ্রামের লাইলি বেগম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, তার ছোট মেয়ে সুমিকে (১৪) চার মাস আগে গার্মেন্টসের কাজে চিটাগাং পাঠিয়েছেন। তাদের গ্রামে আশপাশ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ জন মেয়ে গার্মেন্টস এ কাজ করতে চিটাগাং গেছে।
খোন্তাকাটা গ্রামের যুবক ইকবাল মৃধা বলেন, ‘কাজের অভাবে মানুষ খাইতে পারছে না। দ্যাশে কোন কাম-কাজ নেই।’
তাফালবাড়ি গ্রামের ইসারুল ইসলাম (২৭) বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, এলাকায় কৃষি উৎপাদনও তেমন ভালো হয় না। কাজের খোঁজেই মুলত এখান থেকে লোকজন দুরে যাচ্ছে। আমার অনেক বন্ধু এখন চিটাগাং, সিলেটে কাজ করে। এলাকায় ভালো কাজ থাকলে তারা দুরে যাইতো না।
রায়েন্দা গ্রামের বাসিন্দা সেকেন্দার মৃধা (৬৫) বলেন, এলাকায় কাজ না থাকায় গত ক’বছরে এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষ চলে গেছে চিটাগাং (চট্টগ্রাম)। আবার চোরাই পথে এখান থেকে লোকজন কাজ করতে ইন্ডিয়া যায়। এ অঞ্চল থেকে ভারতে যাওয়া লোকেদের একটি বড় অংশ কাজ করছে ব্যাঙ্গালোরএ।
উপজেলার চাল রায়েন্দা গ্রামের আব্বাস হাওলাদারের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৩৫) বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, তিন বছর হলো কাজের জন্য তার স্বামী ভারত গেছে। মাঝে মাঝে ফোন করে। বলছে এখন নাকি ব্যাঙ্গালোর আছে। এখন ঠিকমত টাকা পয়সাও পাঠায় না।
এমন ঘটনা যে কেবল একটি দুটি নয় তার প্রমান মিলে ২০১৫ সালে ৭ আগস্ট বাগেরহাটের দড়াটানা ব্রিজ এলাকা থেকে নারী শিশুসহ ১৮ ভারত গামী উদ্ধার হওয়ার ঘটনায়। উদ্ধার হওয়া সবাই বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। পুলিশের জিঞ্জাসা বাদে তারা সবাই কাজের জন্য ভারত যাচ্ছে বলে দবি করেছিলো।
উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে মোরেলগঞ্জ উপজেলার খাউলিয়া এলাকার মাধুরী আক্তার (১৮) নামে এক নারী তখন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেছিলেন, সে তার ভাই হারুন শেখের সাথে কাজের উদ্দেশ্যে ভারতের ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছিলেন। ১৬ মাস আগে তার স্বামীও কাজের জন্য সে দেশে যায়। অবৈধ ভাবে যাওয়ার অপরাধে তার প্রায় ৮ মাস তার স্বামী ভারতের কারাগারে থাকতে হয়েছিলো বলেও মাধুরী জানিয়েছিলেন।
উদ্ধার হওয়া বাকিরাও জানিয়ে ছিলেন, তাদের অধিকাংশের নিকট আত্মিয় ভারতে কাজ করে।
বাগেরহাটের সিনিয়র সাংবাদিক আহাদ হায়দার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, কাজের সন্ধানে এই এলাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা যাওয়ার একটা প্রবনতা বর্তমান সময়ে বেড়েছে। যেহেতু এখানে কাজ নেই বা তার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেনা তাই তারা অন্যত্র যাচ্ছে। তাছাড়া এই অঞ্চল থেকে কাজ করতে ভারত যাওয়ার একটা প্রবনতা বহু পূরনো।
তবে এটাকে আবার মাইগ্রেসন বলা যাবে না। কারন তারা একেবারে চলে যান না। কেবল মাত্র কাজের জন্য যান। পরিবারের একজন বা দু’জন সদস্য উপার্জনের জন্য বাইরে গেলেও বাকিরা এলাকায়ই থাকেন।
শরণখোলায় কাজ করা বেসরকরি উন্নয়ন সংস্থা অগ্রদুত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচারক মো. আউব আলী আকন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আসলে ত্রান সহায়তার মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় না। এ জন্য আলাদা বিনিয়োগ প্রয়োজন। সিডরের পর বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্রধানত ত্রান তৎপরতা চলেছে। কিন্তু আর্থসামাজিক উন্নয়ণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয় নি। তারই কাজের খোঁজে লোকজনকে অন্যত্র যেতে হচ্ছে।
এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি-বেসরকরি উদ্দ্যেগে ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প স্থাপন এবং দীর্ঘ্য মেয়াদি পরিকল্পনার গ্রহণ করে বাজার সৃষ্টিও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
⇒ সিডরের ৯ বছরেও হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ
⇒ উপকূলের বিভীষিকা সিডর !
এইচ/এসআই/বিআই/১৬ নভেম্বর, ২০১৬