সুন্দরবনের পশুর নদীতে কয়লা বোঝাই কার্গো ডুবির দু’ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও শুরু হয় নি উদ্ধার কাজ। কার্গো জাহাজটি পশুর নদীতে ডুবে থাকায় ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ছে বনের জলজ জীববৈচিত্রের।
২৭ অক্টোবর ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের জয়মনি সংলগ্ন বিউটি মার্কেট এলাকায় কার্গো জাহাজ এমভি জি আর রাজ তলা ফেটে ডুবে যায়। কার্গো ডুবির ঘটনায় সুন্দরবনের ক্ষতি বিবেচনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে তা উত্তোলনের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।
তবে দুই সপ্তাহ পার হলেও সোমবার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত জাহাজটির উত্তোলন কাজ শুরু হয়নি। ফলে কয়লা পশুর নদীতে মিশে গিয়ে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের উপর প্রভাব পড়বে বলে ধারনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উদ্ধার কাজে ধীরগতি:
মংলা সমুদ্র বন্দরের পশুর চ্যানেলের হারবাড়িয়া থেকে বিদেশি জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) গ্লোভস্টোন থেকে ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই করে খুলনার দিকে যাচ্ছিল এমভি জি আর রাজ কার্গো জাহাজটি। ২৭ অক্টোবর রাতে তলা ফেটে কার্গো জাহাজটি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার জয়মনি সংলগ্ন পশুর নদীর বিউটি মার্কেট এলাকায় ডুবে যায়।
এঘটনায় বন বিভাগ মামলা দায়েরসহয় মালিক দিল খানকে দ্রুত কার্গোটির উদ্ধারের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়। মালিক পক্ষ কার্গো জাহাজটি উত্তলনের নারায়নগঞ্জের ভাই ভাই স্যালভেজ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। এর পর ৫ নভেম্বর উদ্ধারকারি ওই প্রতিষ্ঠানর কয়েক জন কর্মী ৫ নভেম্বর পশুর নদীর ঘটনাস্থালে পৌঁছায়।
| তেল কয়লায় একাকার, সুন্দরবন চমৎকার !
ডুবে যাওয়া কার্গো এমভি জি আর রাজের মালিক পক্ষ এবং উদ্ধারকারি প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, কার্গো জাহাজটিতে থাকা কয়লা উত্তোলনের পর মূল কার্গোটি উদ্ধারের কাজ করা হবে। তবে কার্গো উত্তোলনে আসা বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মচারী দু’টি ট্রলার বোর্ড ও কয়লা উত্তোলনের সরঞ্জামাধি নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও সোমবার (৯ নভেম্বর) পর্যন্ত প্রাথমিক ওই দলটি কয়লা উত্তোলনের কাজও শুরু করতে পারে নি। ভাই ভাই স্যালভেজ ও মালিক পক্ষ থেকে সংবাদ কর্মদের কয়েক দফায় কয়লা উত্তোলনের কথা জানানো হলেও সোমবার পর্যন্ত শুরু হয়নি উদ্ধার কাজ।
ঘটনাস্থলে থাকা ভাই ভাই স্যালভেজের অন্যতম সদস্য মো: মাহাবুব হোসেন সোমবার মুঠোফেনে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে কার্গোর কয়লা উত্তোলন কাজ শুরু হবে। আর এতে ৮/ ১০ দিন সময় লাগতে পারে।
বাড়ছে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কা:
দুই সপ্তাহ ধরে পশুর নদীতে কয়লাবাহী কার্গো ডুবে থাকায় সুন্দরবনের ক্ষতির পরিমান বাড়াচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ ও সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ কর্তিপক্ষ।
এরই মাঝে বন বিভাগ ঘটনাস্থনের (পশুর নদীর) পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছে। ওই নমুনায় ক্ষতিকর উল্লেখ যোগ্য তেমন কোন উপাদান ধরা না পড়লেও দীর্ঘ্য সময় কয়লা পানিতে ডুবে থাকলে বনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজর উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: শাহ আলম ফরাজি জানান, কয়লায় কার্বোন থাকে যা পানির সাথে মিশে কার্বোনডাই অক্রাইট এমনকি কার্বোনেট এসিড তৈরী করতে পারে। ফলে পানি দূষিত হবে। যা সুন্দরবনের শ্বাসমূল ও ঠেসমূলসহ উদ্ভিদের অনেক ক্ষতি করবে।
এছাড়া অক্সিজেনের অভাব দেখা দেবে যার কারনে অনেক জলজ প্রাণী মারা যাবার অশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ফার্নেস অয়েল ছিল এক ধরনের কয়লা অন্য আরেক ধরনের। বিপদ হলো কয়লা প্রতিদিনই পানির সাথে মিশছে, অর্থাৎ প্রতিদিন সুন্দরবনের নদীর পানিতে বিষাক্ত কার্বন মিশছে। এতে করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র, ইকোসিস্টেমের উপর বড় ধরনের প্রভাব পরছে।
এখন উদ্ধারের নামে একে অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। একজন বলছে বন বিভাগের দায়িত্ব, তো আরেক জন বলছে বিআইডাব্লিউটিএ আর মংলা বন্দরের। আবার তারা বলছে উদ্ধারের দয়িত্ব মালিক পক্ষের- এটাই বাস্তবতা। কিন্তু ফলাফল হলো আমাদের বনের ক্ষতি হচ্ছে।
এধরনের ছোট একটি নৌযান উদ্ধারে এমন সমন্বয়হীনতা ও গাফিলতি দু:খ জনক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন:
কয়লাবাহী কার্গোডুবির পর দিন সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ ঘটনার করান অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরুপনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি ৩১ অক্টোবর তাদের প্রতিবেদনে কয়লাবোঝাই কার্গোডুবির কারণ হিসাবে এমভি জি আর রাজের মাস্টার ও ইঞ্জিন ড্রাইভারের গাফিলতি ও অদক্ষতাকে দায়ী করে। একই সাথে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনায় বনের ক্ষতি এড়াতে সংরক্ষিত এলাকায় পণ্যবাহী ও বানিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার সুপারিশও করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটির সদস্য সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা গাজী মতিয়র রহমান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, প্রতিবেদনে বানিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা ছাড়াও আরও কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বনের ভেতর দিয়ে চলাচল করা সব জলযানের যথাযথ ফিটনেস ও দক্ষ চালক মাস্টার নিশ্চিত করা, সুন্দরবনের নদীগুলোতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত উদ্ধারের জন্য মংলা বন্দরে আধুনিক সরঞ্জাম মজুদ রাখা, দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে ডুবে যাওয়া নৌযান মালিকপক্ষ নিজেদের উদ্যোগে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলে বন্দর বা নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করবে বলে যে আইন আছে তা সংশোধন করে দ্রুত জাহাজ উদ্ধারে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ডুবেযাওয়া কার্গো উদ্ধার কাজের বিলম্ব সুন্দরবনের জন্য ক্ষতির আশংকা বাড়াচ্ছে বলে মনে করে বন বিভাগও।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমরা বনের ক্ষতি বিষয়ে আদালতে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিব। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সুন্দরবনরে ভেতর দিয়ে সকল প্রকার বানিজ্যিক জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়া উৎচিত।
ডুবে যাওয়া কার্গো মালিক মঙ্গলবার থেকে উদ্ধার কাজ শুরু হওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ ধরনের দুর্ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতার জন্য মংলায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএর জরুরী রেসকিউ টিম গঠন করা উৎচিত। বন্দরের উদ্ধারকারী জাহাজ, অনান্য সমরঞ্জাম এবং পূর্ণঙ্গ রেসকিউ টিম থাকলে দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষনিক উদ্ধার কাজ শুরু করা যাবে। এতে দুর্ঘটনার কবলিত জাহাজ দ্রুত উদ্ধার করা যাবে। যা বনের উপর ক্ষতি এবং উদ্ধার কাজের ব্যায় কমাবে।