প্রচ্ছদ / খবর / সিডরের ৮ বছর: সেই ভয়াল স্মৃতি আজও কাঁদায় উপকূলবাসীকে

সিডরের ৮ বছর: সেই ভয়াল স্মৃতি আজও কাঁদায় উপকূলবাসীকে

15November-pic১৫ নভেম্বর! ২০০৭ সালের এই দিনে উপকূলের আঘাত হানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণীঝড় ‘সিডর’। ভয়াল সে রাতের কথা মনে পড়লে আতঙ্কে এখনও শিউরে ওঠেন উপকূলের লাখো মানুষ।

সুন্দরবন অতিক্রম করে ঘূর্ণীঝড় সিড়র সে রাতে প্রথম আঘাত হানে বলেশ্বর নদী তীরের জনপদ শরণখোলা উপজেলার সাউথখালীতে। ঘন্টায় প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঝড়ো বাতাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাগেরহাট, খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ আসপাশের অন্তত ১৬টি উপকূলীয় জেলা।

মুহূর্তের ধ্বংসলীলায় বিধ্বস্ত বসতবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, সড়ক, নৌ, বিদ্যুৎ এবং টেলিযোগাযোগসহ আধুনিক সভ্যতার সার্বিক অবকাঠামো। সিড়রের সেই ভয়াল আগ্রাসন ও জলোচ্ছ্বাসের ছোবলে প্রাণ হারান উপকূলের অন্তত্য ৫ হাজার মানুষ। নিখোঁজ আর আশ্রয়হীণ হয়ে পড়েল কয়েক লক্ষ।

স্মরণকালের ভয়াবহ সেই ঘূর্ণিঝড় আজও এক বিভীষিকা হয়ে গেঁথে আছে উপকূলবাসীর মনে।

SIDR-after-7Years-Pic-07সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সিড়রে ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় ১৬ জেলার মধ্যে কেবল বাগেরহাট জেলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৯০৮ জন। তবে বেসরকারী হিসাবে প্রাণহানীর এ সংখ্যা ছিলো পাঁচ হাজারের বেশী।

সিডর আক্রান্ত এলাকায় কাফনের কাপড়ের অভাবে অনেকে নিহতের মরদেহ পলিথিনে মুড়িয়ে দাফন করেন। কবরের জায়গার অভাবে একটি কবরে এক সঙ্গে দাফন করা হয় ২৪ জনকে। অনেক মরদেহের কোনো পরিচয়ও পাওয়া যায়নি। যাদের অজ্ঞাত পরিচয়ে দাফন করেন স্থানীয়রা।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুসারে, সিডরের আঘাতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছিল জেলায় ৬৩ হাজার ঘরবাড়ি। আহত হয়েছিল ১১ হাজারের বেশী মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দুই লাখ ৮৩ হাজার ৪৮২টি পরিবার, ৩৬৭ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৮৬২ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক, প্রায় ৬৫ কিলোমিটার বাঁধ এবং ৭৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের রক্ষা কবজ সুন্দরবন। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছিল জেলার শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মংলা উপজেলা জুড়ে।

Sidor-6-yearসংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রকৃতির এ ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখে শিউরে ওঠে গোটা বিশ্ব। সাহায্যের হাত বাড়ান দেশি-বিদেশিরা।

সিডরের মতো প্রলয়ংকারী ঝড়ে বেঁচে যাওয়া বিপন্ন জনপদের মানুষেরা আবারও শুরু করেন জীবণ যুদ্ধ। সব কেড়ে নেওয়া নিস্ব মানুষের বেঁচে থাকার সে সংগ্রামের ৮ বছর পেরিয়েছে। তবে এখনও পুরোপুরি ঘুরে দাড়াতে পারেননি উপকূলের লাখো মানুষ।

শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের চাল রায়েন্দা গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা বেগম (৩৫) বলেন, সিড়রের সেই রাতের কথা আর মনে করেত চাই না। ঝড়ের সাথে পানির তোড়ে সবই শেষ হয়ে গেছিলো। সে রাতে একটা গাছ ধরে কোন রকম বেঁচে ছিলাম। এখনও সারাক্ষন ভয়ে থাকতে হয়।

সাউথখালী ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. জাকারিয়া বলেন, এলাকার মানুষ এখনও সারাক্ষণ ভয়ে থাকে। আকাশে মেঘ দেখলে মানুষেরা ছোটে আশ্রয়ের সন্ধানে। বর্ষায় নদী উত্তাল হয়, জোয়ারের পানি বাড়ে। নদী তীরে বাঁধের পাশে থাকা মানুষেরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটায়।

SIDR-after-7Years-Pic-04শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন বলেন, উপজেলার প্রাণকেন্দ্র ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যকেন্দ্র রায়েন্দা বাজারটি আজও রয়েগেছে বাঁধের বাইরে। এখানে নিরাপত্তাহীন আরও বেশকিছু বাড়িঘর ও সরকারি স্থাপনা। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় গোটা বাজার। ৮বছরেও মাত্র আড়াই কিলোমিটার বাঁধের দাবি পুরোন হয় নি এলাকাবাসীর।

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সাউথখালী ও তাফালবাড়িয়ার নদী তীরবর্তী গ্রাম গুলোতে নেই বড় কোন গাছ। সিড়রে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া এই এলাকার বড় গাছগুলো ভেঙে চুরমার হয়েছিল। ছয়-সাত বছর বয়সী গাছের চারাগুলো কেবল মাথা তুলেছে। এই গাছপালা বড় হতে সময় লাগবে আরও কয়েক বছর। বছরে বছরের দুর্যোগের ঝাপটা কাটিয়ে কবে নাগাদ এই গাছগুলো আবার নিরাপত্তা দেবে, তা কারও জানা নেই কারো।

সিডর পরবর্তী সরকারি এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রলয়ঙ্কারী ওই ঘূর্ণীঝড়ে বাগেরহাট জেলায় মোট ৪৫৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল।

সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী সিড়রের কারণে তখন নষ্ঠ হয়েছিল প্রায় ৬ লক্ষ টন ধান, মারা যায় প্রায় ২ লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু ও হাঁসমুরগী। ধ্বংস হয় ৯ লখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি, দুই লাখ দশ হাজার হেক্টর জমির ফসল। মারাত্মক ক্ষতির পাশাপাশি সুন্দরবনের বিপুল সংখক প্রাণী মারা পড়ে ঝড়ের আঘাতে।

SIDR-after-7Years-Pic-08সিডর আঘাত হানার পর টেকসই বেড়িবাঁধ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন দাবি আজও পুরণ না হওয়ায় বিপন্ন জনপদের মানুষেরা আজও আছেন চরম ঝুকিতে। দ্রুত এসব দাবি পূরণ না হলে আবারও কোন ঝড়ে সব হারাবার সঙ্কা তাদের।

উপকূলের মানুষ চায় ১৫ নভেম্বর সরকারিভাবে ‘সিডর দিবস’ পালিত হোক। রোববার দিবসটি উপলক্ষে উপকূলবাসী শোকর‌্যালি, স্মরণসভা, মিলাদ মাহফিল, দোয়া অনুষ্ঠান ও কাঙালি ভোজের আয়োজন করেছেন।

১৫ নভেম্বর :: সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
এস/আইএইচ/এনআরএ/বিআই

About বাগেরহাট ইনফো নিউজ