সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের মংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও কালিকাবাড়ী গ্রামের বিনোদ মণ্ডল (৬১) ছিলেন স্বচ্ছল কৃষক। পনের বছর আগেও তাদের এক শত দুই বিঘা জমি থেকে প্রতি বছর তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মন ধান তুলতেন। জমি ও পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে জমি প্লাবিত হওয়ার মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন কারণে এখন আর তার জমিতে ধান হয় না।
গত চার পাঁচ বছর ধরে তিনি দশ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে পনের-কুড়ি মন ধান পেয়েছেন। এ বছরও তিনি দশ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন।
বিনোদ মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে হাজার মনের তিনটি ধানের গোলা এখন শূণ্য পড়ে থাকে। পুকুরে মাছ নেই। বাগানে ফলের গাছ নেই। কর্মসংস্থান না থাকায় এলাকার অনেক মানুষ এখন গ্রাম ছাড়ছেন। আমাদের ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় বারো হাজার।’
একই ইউনিয়নের কাইনমারী গ্রামের কাজী রুহুল আমিন (৬০) বলেন, ‘আমি নিজের চার বিঘা জমিসহ অন্যের কাছ থেকে বর্গা নেয়া পনের বিঘা জমিতে ধান চাষ করতাম। আমার চারটি হালের বলদ ছিল। বিঘা প্রতি কুড়ি মন করে ধান পেতাম। সেই ধান দিয়ে বছরের খোরাকি রেখে বিক্রীও করতাম। কিন্তু এখন জমিতে কোন ধান হয় না। ধান চাষ করতে যেয়ে আমি স্থানীয় কৃষি ব্যাঙ্ক থেকে পনের হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা ঋণখেলাপী হয়েছি। স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান না হওয়ায় আমার চার ছেলে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।’
অপূর্ব সরদার বলেন, তার আট বিঘা জমিতে বছরে যে আমন ধান হতো তা দিয়ে তার দশজনের সংসার ভালোভাবে চলে যেত। এ ধানের জমিতে কয়েক বছর ধরে লবন পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। মংলার কাইনমারী গ্রামের তিনশ বিঘা জমি ঘিরে সরকার দলীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি চিংড়ি মাছের চাষ করছেন।এখানে আমার মতো অন্তত জন ৪০ জন জমির মালিক জলাবদ্ধতার কারণে ধান চাষ করতে পারছেন না।
মংলা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নূর আলম শেখ জানান, ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত মংলা উপজেলার লোকসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং ব্যাপক চিংড়ি চাষের কারণে এলাকার ফসলী জমি নষ্ট হচ্ছে। মাটি ও পানির লবনাক্ততা বাড়ছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে এলাকার দরিদ্র ও প্রান্তিক আয়ের অনেক মানুষ জীবিকার সন্ধানে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
বেড়ীবাঁধ না থাকায় গত তিন চার বছর ধরে বর্ষাকালে অস্বাভাবিক জোয়ারে মংলা পৌরসভাসহ গ্রাম এলাকা প্লাবিত হয়ে অস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এলাকার ফলজ ও বনজ গাছপালাও মরে যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া হলে নিকট ভবিষ্যতে মংলা একটি বিরান এলাকায় পরিণত হবার আশঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিন মংলার চাঁদপাই ও চিলা ইউনিয়ন এলাকা বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে চাঁদপাই ইউনিয়নের ফসলী জমিতে লবনপানি ঠেকাতে গ্রামবাসীর তোলা এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে চড়কখালী খালে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চিংড়ি ঘের মালিকরা গ্রামবাসীর নির্মান করা বাঁধটি কেটে দেন। গ্রামবাসীরা জানান, শুধু চড়কখালী খালই না, মংলা এলাকায় ধানের উৎপাদন বাড়াতে হলে অগ্রহায়ণ মাসে খালগুলোতে বাঁধ দিয়ে লবন পানি ঠেকাতে হবে এবং আষাড় মাসে পানির লবনাক্ততার মাত্রা কমে আসলে বাঁধ ছেড়ে মাঠে পানি ঢুকাতে হবে। কিন্তু চিংড়ি ঘের মালিকদের কারণে তা করা সম্ভব হয় না।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আমন প্রধান মংলায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ১২ হাজার ৭০৫ হেক্টর। লবনাক্ততা ও চিংড়ি ঘেরের কারণে গত বছর মাত্র দেড় হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষমাত্রা ধরা হলেও তা অর্জিত হয়নি। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বোরো চাষের মৌসুমে ১৬২ হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চাষ হয় মাত্র নয় হেক্টর জমিতে। চলতি বোরো মৌসুমে মংলায় মাত্র দশ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
মংলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ মো: শহিদুজ্জামান বলেন, মংলা উপজেলার সর্বত্র লবনাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। ফলে ধান হচ্ছে না। চিংড়ি ঘেরের কারণে আবদ্ধ পানির নীচে থাকা ফসলী জমিতে লবন জমে যাচ্ছে। জোয়ার ভাটা প্রবাহ কমে যাওয়ায় এবং খালগুলো উন্মুক্ত না থাকায় মাটিতে জমে থাকা লবন কমানো যাচ্ছে না। সরকারীভাবে চলতি মৌসুমে দশ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বোরো আবাদ এখানে বাস্তব সম্মত না হওয়ায় চাষিরা বোরো চাষে আগ্রহী হচ্ছেন না।
তিনি আরো জানান, ২০০৯ সালে মংলার প্রতি মিটার জমিতে লবনাক্ততার মাত্রা সর্বোচ্চ ২৮ ডিএস মাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এখানকার নদীর পানিতে মার্চ থেকে জুলই মাস পর্যন্ত গড়ে ১৮ থেকে ২০ পিপিটি মাত্রার এবং চিংড়ি ঘেরের পানিতে ১২ থেকে ১৪ পিপিটি মাত্রার লবন পাওয়া যাচ্ছে। ২০০৯ সালে আইলার সময় পানিতে ২৫ পিপিটি লবনাক্ততা রেকর্ড করা হয়।
জানা গেছে, বাগেরহাট সদর উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ১৯ হাজার ৯৬৪ হেক্টর বর্তমানে চাষ হচ্ছে ১১ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে, ফকিরহাট উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ৯ হাজার ৯৪৭ হেক্টর বর্তমানে চাষ হচ্ছে ৫ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে, মোল্লাহাট উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ১১ হাজার ৭৩০ হেক্টর, বর্তমানে চাষ হচ্ছে ২ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে, রামপাল উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ১৯ হাজার ৪৮০ হেক্টর চাষ হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে, কচুয়া উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর চাষ হচ্ছে ৮ হাজার ১০৫ হেক্টর জমিতে, মোরেলগঞ্জ উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ২৮ হাজার ৫২০ হেক্টর চাষ হচ্ছে ২৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে, শরণখোলা উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ৯ হাজার ৪০২ হেক্টর চাষ হচ্ছে ৮ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে, মংলা উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ১২ হাজার ৭০৫ হেক্টর চাষ হচ্ছে এক হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে এবং চিতলমারী উপজেলায় আবাদী জমির পরিমান ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর চাষ হচ্ছে ৫ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে এ জেলায় রোপা আমনের আবাদী জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ নয় হাজার ১৩০ হেক্টর, বোরো ৩২ হাজার ৬৯০ হেক্টর, এবং আউশ ৬ হাজার ৩৯৫ হেক্টর। ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে রোপা আমন এক লাখ ৬ হাজার ৭৫৩ হেক্টর, বোরো ৩৭ হাজার ৮০৫ হেক্টর, আউশ ৭ হাজার ৩৮৫ হেক্টর। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে রোপা আমন এক লাখ ৫ হাজার ২৬৭ হেক্টর, বোরো ৪৫ হাজার ৭২৩ হেক্টর এবং আউশ দশ হাজার ৭৩১ হেক্টর। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে রোপা আমন ৮০ হাজার ৮৬০ হেক্টর, বোরো ৪৬ হাজার ১৮৫ হেক্টর এবং আউশ ৮ হাজার ৫১৬ হেক্টর। সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থ বছরে রোপা আমন ৭৩ হাজার ৫২০ হেক্টর, বোরো ৪৮ হাজার ৩৯০ হেক্টর এবং আউশ ৩৭ হাজার ৫২০ হেক্টর।
বাগেরহাট কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কায়েম উদ্দিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাগেরহাটে প্রধান ফসল রোপা আমন ধানের উৎপাদন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সর্বশেষ গত দুই বছরে জেলায় রোপা আমনের আবাদী জমি কমেছে ৩১ হাজার ৭৪৭ হেক্টর। সব থেকে বেশী প্রভাব পড়ছে উপকূলীয় উপজেলা মংলা, রামপাল, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এক জরিপে দেখা গেছে জেলায় গত তেরো বছরে আমন ধানের আবাদী জমির পরিমান কমেছে ৩৯ হাজার ৪৭০ হেক্টর।
তিনি আরো বলেন, বাগেরহাটের সবচেয়ে লবনাক্ত উপজেলা মংলা ও রামপালে লবন সহিষ্ণু বিআর ৪৭ ধানের জাত গত তিন বছর ধরে চাষ করা হচ্ছে তবে ফলন আশানুরুপ নয়।
অলীপ ঘটক, বাগেরহাট।