একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাগেরহাটের রাজাকার নেতা শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড এবং খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) দুপুরে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এই রায় ঘোষণা করেন।
এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে বলা হয়, আসামি সিরাজের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আর আকরাম দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তিনটি অভিযোগের মধ্যে একটিতে।
ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে, অথবা গুলি করে সিরাজ মাস্টারের দণ্ড কার্যকর করতে বলেছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর আকরামকে স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাটাতে হবে জেলখানায়।
সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেনের সঙ্গে এ মামলায় আব্দুল লতিফ তালুকদার (৭৫) নামে আরেক রাজাকার সদস্য অভিযুক্ত হন। কিন্তু রায়ের আগেই গত ২৭ জুলাই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মৃত্যু হওয়ায় তার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
| যুদ্ধাপরাধ: বাগেরহাটের আব্দুল লতিফের মৃত্যু
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির বিরোধিতা করে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এ মামলার আসামিরা।
খুলনার আনসার ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা অন্যান্য রাজাকার সদস্যদের সঙ্গে বাগেরহাটের সদর, কচুয়া, মোরেলগঞ্জ ও রামপাল থানার বিভিন্ন গ্রামে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ চালান, তার বিবরণ এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে।
এ পর্যন্ত রায় আসা ২১টি মামলার ২৪ আসামির মধ্যে সিরাজকে নিয়ে মোট ১৬ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হল।
এ মামলার মোট সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম ছয়টিতে সিরাজের বিচার চলে। এর মধ্যে ১ থেকে ৫ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের মতো অপরাধের দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দিয়েছে আদালত।
আর আকরামের অপরাধের বিচার হয়েছে ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে। এর মধ্যে প্রথম দুটি ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে আদালত। ৭ নম্বর অভিযোগে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় তাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড।
আদালত ১৩৩ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত সার পড়ে শোনানোর সময় সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা ও টুপি পরিহিত সিরাজ এবং ছাই রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত আকরামকে অনেকটাই ভাবলেশহীন দেখা যায়।
| ‘মাস্টার’ থেকে ‘কসাই’ সিরাজ | কৈশোরেই যুদ্ধাপরাধী আকরাম
মামলার আদ্যোপান্ত –
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাটের কচুয়ার শাঁখারীকাঠি বাজারে ৪২ জনকে গণহত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ ছয়টি অভিযোগে ২০০৯ সালে সিরাজ মাস্টারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।
ওই গণহত্যায় নিহত রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস কচুয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলাটি পরে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
গতবছর ১০ জুন ট্রাইব্যুনাল তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে পরদিন লতিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে কচুয়া থানা পুলিশ। এরপর ১৯ জুন আকরাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয় রাজশাহী থেকে। ২০ জুলাই গ্রেপ্তার হন সিরাজ মাস্টার।
প্রসিকিউশনের তদন্ত দল গতবছর ২৫ অগাস্ট এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর ৫ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়।
এরপর গতবছর ৫ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সিরাজ, আকরাম, লতিফের যুদ্ধাপরাধের বিচার। ২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করে।
| বাগেরহাটের যুদ্ধাপরাধীদের রায় ১১ আগস্ট
২ ডিসেম্বর থেকে গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত সিরাজ, লতিফ ও আকরামের বিরুদ্ধে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ মোট ৩২ জন সাক্ষ্য দেন।
এরপর গত ৬, ৭ ও ২১ এপ্রিল আসামিদের পক্ষে পাঁচজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। এরা হলেন- মো.আমজাদ শেখ, সরদার আব্দুল মান্নান, আব্দুর রশিদ মল্লিক, ইউসুফ আলী দিহিদার ও মো. ফেরদৌস খান।
১৫ জুন প্রসিকিউটর সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। আসামি লতিফ তালুকদার অসুস্থ হয়ে পড়লে যুক্তিতর্ক স্থগিত করে আদালত। পরে ১৭ জুন সুমন যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন।
আসামি আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খানের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারওয়ার হোসেন যুক্তি উপস্থাপন করেন ১৮ জুন। ২১ জুন যুক্তি উপস্থাপন করেন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান। এই আসামি আর্থিক অসঙ্গতির কথা বলায় আদালত তার মামলা লড়তে আইনজীবী নিয়োগ দেয়।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ায় মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
রায়ের আগেই গত ২৭ জুলাই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় ৭৫ বছর বয়সী লতিফের। এরপর গত ৫ অগাস্ট এ মামলা থেকে তার নাম বাদ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল রায়ের দিন ঠিক করে দেয়।