একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার ও খান আকরাম হোসেনের মামলার রায় দেওয়া হবে আগামী ১১ আগস্ট।
বুধবার (৫ আগস্ট) রায়ের এ দিন ধার্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এ মামলার তিনজন আসামির মধ্যে অন্যজন আব্দুল লতিফ তালুকদার গত ২৮ জুলাই মারা গেছেন। ফলে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবেন তিনি।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করবেন। বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় গত ২৩ জুন রায় ঘোষণা অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
১৫, ১৭ ও ২৩ জুন রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন ও প্রসিকিউটর মোশফেক কবির। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ১৭ ও ২১ জুন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল আহসান এবং খান আকরাম হোসেন ও লতিফ তালুকদারের পক্ষে ব্যারিস্টার এম সারওয়ার হোসেন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
গত ৬, ৭ ও ২১ এপ্রিল আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন পাঁচজন সাফাই সাক্ষী। তারা হচ্ছেন মো. আমজাদ শেখ, সরদার আব্দুল মান্নান, আব্দুর রশিদ মল্লিক, ইউসুফ আলী ডিহিদার এবং মো. ফেরদৌস খান।
অন্যদিকে গত বছরের ২ ডিসেম্বর থেকে গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হেলাল উদ্দিনসহ ৩২ জন সাক্ষী। তাদের মধ্যে ঘটনার ৩০ জন সাক্ষী হচ্ছেন দিলীপ দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, কমলা রানী চক্রবর্তী, তপন কুমার দাস, অরুণ দাস, নন্দলাল দাস, নিমাই চন্দ্র দাস, আনন্দ লাল দাস, আব্দুল আজিজ, মো. আলতাফ হোসেন কোটাল, জাহিদুল ইসলাম মন্নু, শেখ ফজর আহমেদ, সোবহান শেখ, সোহরাব নকিব, সোলায়মান সরদার, প্রেমানন্দ মজুমদার, প্রাণকৃষ্ণ হালদার, শিশির বিশ্বাস, শেখ মোস্তাফিজুর রহমান বাদশা, আহমেদ আলী শেখ, সোলেমান হালদার, মীর আব্দুর রাজ্জাক, মল্লিক খলিলুর রহমান, সুকুমার দাস এবং মো. মনিরুল ইসলাম। আর জব্দ তালিকার সাক্ষী হচ্ছেন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) ক্যাটালগার রবিউল আনাম খান।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন।
গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজাকার কমান্ডার ‘বাগেরহাটের কসাই’ বলে কুখ্যাত সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং তার দুই সহযোগী আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খাঁনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে ৩টি করে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের শাঁখারিকাঠি বাজার, রনজিৎপুর, ডাকরা ও কান্দাপাড়া গণহত্যাসহ ৮ শতাধিক মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১৪ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউশন। ২৫ আগস্ট তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করেন তদন্ত সংস্থা।
ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছরের ১০ জুন এ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১১ জুন আব্দুল লতিফ তালুকদার, ১৯ জুন আকরাম হোসেন খাঁন ও ২১ জুলাই সিরাজ মাস্টারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় এ তিনজনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ –
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৩ মে বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা বাগেরহাটের সদর থানার রনজিৎপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়ি-ঘর লুণ্ঠন করে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় নিরস্ত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৪০/৫০ জনকে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে একা অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২১ মে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২/৩ হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাগেরহাটের রামপাল থানার ডাকরার কালীমন্দিরে জড়ো হন। সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এ হামলা চালিয়ে সেদিন ৬/৭শ’ জনকে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে ‘কসাই সিরাজ’ বলে কুখ্যাত শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে একা অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ জুন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগেরহাটের সদর থানার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া ও কান্দাপাড়া বাজার এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ, নিরস্ত্র ২০ জনকে অপহরণের পর তাদেরকে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। পরে তাদের মধ্য থেকে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়। একজন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। এ অভিযোগে শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে আটক, নির্যাতন, অপহরণ, হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বাগেরহাটের সদর থানার চুলকাঠিতে হামলা চালিয়ে ৫০টি বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭ জন নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা। এ অভিযোগেও সিরাজ মাস্টারকে একা অভিযুক্ত করা হয়েছে।
শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারকে অভিযুক্ত করে পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগেরহাটের কচুয়া থানার শাখারিকাঠি হাটে হামলা চালিয়ে অভিযুক্তরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৪২ জন নিরীহ, নিরস্ত্র লোককে আটক করেন। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করেন। এছাড়া তাদের বাড়ির মালামাল লুণ্ঠনের পর অগ্মিসংযোগ করেন। এসব অপরাধ সংঘটিত করেন আসামিরা।
ষষ্ঠ অভিযোগে তিনজনকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাগেরহাটের কচুয়া থানার বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরস্ত্র ৫ জনকে অপহরণ ও আটক করে সিরাজসহ তিনজনের নেতৃত্বে রাজাকাররা। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারকে অভিযুক্ত করে সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের তেলিগাতীতে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদারকে আটক করার পর তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেন আসামিরা।