বিশ্বে বাঘের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসস্থল হিসেবে খ্যাত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে বাঘের সংখ্যা।
মানুষের অপতৎপরতাকে বাঘ এবং বনের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় হুমকি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫ অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সর্বমোট ১০৬টি। ক্যামেরা পদ্ধতিতে করা জরিপের এই ফল অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমেছে প্রায় সাড়ে চার ভাগ। যা মারাত্মক উদ্যেগের।
এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালে বনবিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে সুন্দরবনের খালে বাঘের বিচরণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জরিপ করে বলেছিল যে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি।
তারও আগে ২০০৪ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় বনবিভাগ বাঘের পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করে (পাগ মার্ক পদ্ধতি) বলেছিল, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি। এই সব হিসাব অনুযায়ী এতোদিন বলা হচ্ছিল, সুন্দরবনে প্রায় সাড়ে ৪০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে।
কিন্তু ক্যাপচার ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ শুমারির ফলাফলে দেখা যায়, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা মাত্র ১০৬টি। ক্যামেরা পদ্ধতিতে ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয়ে দুই ধাপে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে শেষ হয় বাঘ শুমারি।
বাঘ শুমারির প্রধান ও বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুল কবীর বলেন, আগে সনাতন পদ্ধতিতে বাঘের পায়ের ছাপ ও গতিবিধির ওপর ভিত্তি করে জরিপ করা হতো। ওই পদ্ধতিতে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব ছিল না।
ফলে ছবি তুলে, খালে বাঘের পায়ের ছাপ গুণে ও তাদের গতিবিধিসহ অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে এবার বাঘ গণনা করা হয়েছে।
এতে প্রকৃত সংখ্যা নিরূপন হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
বাঘ শুমারির চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ মিলে ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সুন্দরবনে মোট বাঘের সংখ্যা ১৭০টি।
বাঘ গণনার ফলাফল প্রকাশ করে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব- শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের জরিপটি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করা হয়নি। ফলে আগের প্রকাশিত বাঘের ওই সংখ্যা সঠিক নয়।
এর আগে ২০০৬ সালে বেসরকারিভাবে ব্রিটিশ জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় ক্যামেরায় ছবি তুলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান সুন্দরবনে বাঘ গণনা করেন। তার গণয় বাঘের সংখ্যা ছিল ২০০টি।
সেই হিসাবে নয় বছরে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর ভারতে ২০১৩ থেকে দুই বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
বনবিভাগের তথ্য মতে, বাঘের ছবি তোলার জন্য সুন্দরবনের বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অংশে ৭১টি এবং খুলনার অংশে ১৩২টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। প্রথম ধাপে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব ব্লকে ৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ক্যামেরা ট্যাপের মাধ্যমে বাঘ গণনা করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ ব্লকে ৬৪০ বর্গ কিলোমিটারে ছবি তোলা হয়। এতে অংশ নেন বনবিভাগের ৩০ জন প্রশিক্ষিত কর্মী। জরিপ চলাকালে প্রতি দুই দিন পর পর ওই ক্যামেরা পরীক্ষা করে বাঘের ছবি দেখা হতো।
এই তিনটি এলাকার মধ্যে বাগেরহাটে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে গড়ে তিন দশমিক সাতটি, সাতক্ষীরায় দুই দশমিক ৭৭ ও খুলনায় এক দশমিক আটটি করে বাঘ বিচরণ করতে দেখা গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সদ্য প্রকাশিত বাঘ শুমারির ফলাফলে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ক্যামেরায় ছবি তুলে মোট ৩৮টি পূর্ণবয়স্ক ও চারটি বাচ্চা বাঘ শনাক্ত করা গেছে। ক্যামেরাবন্দি হওয়া বাঘগুলোর মধ্যে আটটি নারী ও ৩০টি পুরুষ। বাকি ৬৮টি বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েয়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে তাদের পায়ের ছাপ গুণে ও বিচরণের অন্যান্য তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।
জাহিদুল কবীর জানান, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের চার হাজার ৮৩২ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বাঘ বিচরণ করে। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগে বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতি এবং পশ্চিম বনবিভাগে সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, দোবেকি, কৈখালী ও খুলনার নীলকমল, পাটকোস্ট, গেওয়াখালীতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র।
বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের চেয়ে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের নদ-নদী ও খালের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি। তা ছাড়া বাঘের প্রধান খাবার হরিণের সংখ্যাও কম সেখানে। কিন্তু জরিপে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় অংশের সুন্দরবনে বাঘ বিচরণ এলাকায় প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে চারটি ও বাংলাদেশ অংশে দু’টি বাঘ রয়েছে। এটা প্রমাণ করে, বাংলাদেশ অংশে বাঘের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে।
গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দীন খান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, নানা কারণে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমছে। বনের ভেতর দিয়ে নৌ যান চলাচলের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হচ্ছে বন। যা বাঘের স্বাভাবিক বিচরণ বাধাগ্রস্থ করছে।
আবার বনের পাশে বড় বড় স্থাপনাসহ বিশেষ শিল্পাঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। এতে গোটা সুন্দরবনের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। বাঘ রক্ষা করতে হলে আগে সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এসব কারণে বাঘ রক্ষার্থে ২০১৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাঘ রক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ সূত্র মতে, বাঘ রক্ষায় জনবল নিয়োগ, টহল বাড়ানোসহ যেসব পরিকল্পনা বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশ দিয়েছিল, তার বেশির ভাগই এখনও পূরণ হয়নি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, মানুষের অবাধ বিচরণ, বাঘ শিকার-পাচার, বন উজাড়, বাঘের আবাসস্থল সংকটসহ নানা কারণে সুন্দরবনে প্রজননের প্রাকৃতিক পরিবেশ হারাচ্ছে বাঘ। এভাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্থ হওয়ার কারণে বাঘের সংখ্যা কমে আসছে।
ক্যামেরা পদ্ধতিকে করা জরিপের ওপর ভিত্তি করে রোববার (২৬ জুলাই) বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব- শীর্ষক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় অন্যতম হুমকি মানুষের অপতৎপরতা।’
প্রতিবেদ অনুযায়ী, জীববৈচিত্র্য ও খাবারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ অংশে কমপক্ষে ২০০ বাঘ থাকার কথা। কিন্তু অবৈধ শিকার, বনের ভেতরে নদীতে নৌযান চলাচল, খাবারের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বনের পাশে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ বাঘের অস্তিত্ব রক্ষার পথে বড় বাধা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘ আমাদের জাতীয় সম্পদ, আমাদের গর্ব। বাঘ বাঁচাতে হলে এখনই জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।