বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা এখন সর্বসাকল্যে ১০৬টি। আর বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে পুরো সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১৭০টি।
গত এক দশকে এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ক্যামেরা পদ্ধতিতে সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫-এর ফলাফলে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এ জরিপের ওপর ভিত্তি করে ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় অন্যতম হুমকি মানুষের তৎপরতা। বাংলাদেশ অংশে জীববৈচিত্র্য ও খাবারের ভিত্তিতে কমপক্ষে ২০০ বাঘ থাকার কথা। কিন্তু চোরা শিকারিদের বাঘ শিকার, বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল এবং বনের পাশে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ বাঘের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্যামেরায় ছবি তুলে, খালে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে ও তার গতিবিধির অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ ব্যাখ্যা করে এই সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে বন বিভাগ। এই জরিপে বন বিভাগকে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে ভারতের বন্য প্রাণী ইনস্টিটিউট। এতে অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক।
গতকাল রোববার বন বিভাগ জরিপের এই ফলাফল চূড়ান্ত করেছে। প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে এ খবর প্রকাশ করেছে।
এর আগে সর্বশেষ ২০০৪ সালে বন বিভাগ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় বাঘের পায়ের ছাপ গুনে জরিপ করেছিল। এতে বাঘের সংখ্যা এসেছিল ৪৪০টি। এ বছর নতুন এই জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের ওই জরিপটি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করা হয়নি। ফলে আগের ওই বাঘের সংখ্যা সঠিক নয়।
তবে ক্যামেরায় ছবি তুলে ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান ব্রিটিশ জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় সুন্দরবনে বাঘ গণনা জরিপ করেন। তাতে বাঘের সংখ্যা ছিল ২০০টি। সেই হিসাবে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা গত নয় বছরে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ ছাড়া ২০১০ সালে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে সুন্দরবনের খালে বাঘের বিচরণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি জরিপ করে। এতে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি বলে উল্লেখ করা হয়।
বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫-এর প্রধান পরামর্শক ভারতের বন্য প্রাণী ইনস্টিটিউটের প্রধান রাজভেন্দর ঝালা বলেন, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া বাঘের প্রধান খাবার হরিণের সংখ্যাও সেখানে কম। কিন্তু আমাদের জরিপে দেখা গেছে, ভারতীয় সুন্দরবনে বাঘ বিচরণ এলাকায় প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে চারটি ও বাংলাদেশ অংশে দুটি বাঘ রয়েছে। এটা প্রমাণ করে বাংলাদেশ অংশে বাঘের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
রাজভেন্দর বাংলাদেশ অংশে বাঘ রক্ষার উদ্যোগে ঘাটতি থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, শ্যালা নদীতে নৌপথ চালু থাকার ফলে বনটি অবস্থাদৃষ্টে দুই ভাগ হয়ে গেছে। এতে বাঘের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার বনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বিশাল স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এসব তৎপরতা বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের অস্তিত্ব আরও হুমকির মুখে ফেলবে। বাঘ রক্ষা করতে হলে এসব বাধা দূর করতে হবে।
সুন্দরবনে মোট ৩৮টি পূর্ণবয়স্ক ও চারটি বাঘের বাচ্চার ছবি তুলতে পেরেছে বন বিভাগের জরিপ দল। বাকি ৬৮টি বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে খালে তাদের পায়ের ছাপ গুনে ও বিচরণের অন্যান্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। ক্যামেরাবন্দী হওয়া ৩৮টি বাঘের ৩০ শতাংশ পুরুষ এবং বাকিগুলো নারী।
জরিপে দেখা গেছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৪ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘ বিচরণ করে। এদের বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতি; সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, দোবেকি ও কৈখালী এবং খুলনার নীলকমল, পাটকোষ্টা ও গেওয়াখালী। এই তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে ওই জরিপটি চালানো হয়েছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে ১৭টি, সাতক্ষীরায় ১৩টি ও খুলনায় আটটি বাঘের ছবি ধারণ করা হয়েছে।
বাঘের ছবি তোলার জন্য বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ৭১টি করে এবং খুলনায় ১৩২টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। বন বিভাগের ৩০ জন কর্মী ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এ জরিপটি করে। এই সময়ে প্রতি দুই দিন পর পর ওই ক্যামেরা পরীক্ষা করে বাঘের ছবি দেখা হয়। এই তিনটি এলাকার মধ্যে বাগেরহাটে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে ৩ দশমিক ৭টি, সাতক্ষীরায় ২ দশমিক ৭৭ ও খুলনায় ১ দশমিক ০৮টি করে গড়ে বাঘ বিচরণ করতে দেখা গেছে।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ৫২টি বাঘ গ্রামবাসী, চোরা শিকারি ও বিভিন্ন ধরনের অপঘাতে মারা গেছে। এ ছাড়া গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে র্যাব ছয়টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে চারটি চামড়াই পাওয়া গেছে গত ডিসেম্বরে সুন্দরবনের ভেতরে তেলবাহী জাহাজডুবির পর। তবে বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থের একটি চলমান গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১৪ মাসে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের হাতে ১০টি বাঘ ও ৮১টি হরিণ মারা পড়েছে।
বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও বাঘ গণনা জরিপের প্রধান জাহিদুল কবীর বলেন, বাঘের এই নতুন গণনাকে ভিত্তি ধরে আমরা সামনের দিনগুলোতে বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করব।
২০০৯ সালে সরকার টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে।
২০১০ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই ঘোষণায় স্বাক্ষরও করেছে। এতে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশ প্রতি দুই বছর পর পর বাঘ গণনা করবে। বাংলাদেশ ওই ঘোষণার পাঁচ বছর পর বাঘগণনা শেষ করেছে। ভারত ২০১৩ সালে ও নেপাল ২০১৪ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা শেষ করে।
ভারতের বন বিভাগের হিসাবে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশটিতে বাঘের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাঘ রক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। বাঘ রক্ষায় অবকাঠামো তৈরি, টহল বাড়ানো, জনবল নিয়োগের যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে দিয়েছিল, তার বেশির ভাগই পূরণ হয়নি।
এ বিষয়ে বাঘ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে, এটা বোঝাই যাচ্ছে।
চোরা শিকারিদের তৎপরতা, নৌযান চলাচল বাঘের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লাও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে আনার কথা আমরা শুনছি। এটা আরও ঝুঁকিতে ফেলবে। যে বাঘ আমাদের জাতীয় প্রাণী, আমাদের গর্ব, ক্রিকেট দলের লোগো, সেই বাঘকে বাঁচাতে হলে আমাদের জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান ধারায় চললে সুন্দরবনে যে কটি বাঘ আছে, তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।’
আগের জরিপে বাঘের সংখ্যা
২০০৪ সাল
বন বিভাগ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় বাঘের পায়ের ছাপ গুনে জরিপ করেছিল ৪৪০
২০০৬ সাল
ক্যামেরা পদ্ধতিতে অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান ব্রিটিশ জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় বাঘ গণনা করেন ২০০
২০১০ সাল
বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে বাঘের বিচরণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি জরিপ করে ৪০০–৪৫০
তথ্যসূত্র: বন বিভাগ।