আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ ছাড়াই প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন (ইআইএ) তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের নকশা থেকে শুরু করে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সবকিছুতেই রয়েছে মারাত্মক ত্রুটি।
এমন তথ্য দিয়ে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা।
ইকুয়েটর প্রিন্সিপলস (ইপি) হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ফ্রেমওয়ার্ক। ৩৫টি দেশের ৮০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে এ নীতি অনুসরণ করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রকল্প অর্থায়নের আবার ৭০ শতাংশ করে এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইআইএ প্রতিবেদনে ইপির একাধিক শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে বলে মনে করছে বহুজাতিক ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ব্যাংকট্র্যাক।
এ কারণে প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্সের বৃহৎ তিন ব্যাংক বিএনপি পারিবাস, সোসিয়েতে জেনারেলি ও ক্রেডিট এগ্রিকোল এরই মধ্যে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে আপত্তি জানিয়েছে। ছয় মাস আগে নরওয়ের দুটি পেনশন ফান্ডও ভারতের এনটিপিসি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) লিমিটেড যৌথ বিনিয়োগে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে যাচ্ছে। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার ও সুন্দরবন বাফার জোন থেকে চার কিলোমিটার দূরে এ কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ৮৩৪ একর জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জমি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা প্রয়োজন হবে প্রতিদিন ১০ হাজার টন।
ব্যাংকট্র্যাক বলছে, প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইআইএ প্রতিবেদনে যথেষ্ট তথ্য ঘাটতি ও দুর্বলতা রয়েছে। প্রকল্পের নকশা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। তাই ইপির অধীন ন্যূনতম সামাজিক ও পরিবেশগত মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় প্রকল্পটি। এমনকি ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) পারফরম্যান্স স্ট্যান্ডার্ডও রক্ষিত হয়নি। এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) পরিচালক শাহীনুল ইসলাম খান বণিক বার্তাকে বলেন, সব ধরনের মানদণ্ড অনুসরণ করেই পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে ছাড়পত্রও দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।
ব্যাংকট্র্যাকের প্রতিবেদন বলছে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহন এবং এজন্য নদী খননের ফলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে পরিবেশগত আলাদা কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি প্রকল্পটির জন্য পরিবেশ অধিদফতরের দেয়া সাময়িক ছাড়পত্রেও এ বিষয়ে পৃথক মূল্যায়নের উল্লেখ রয়েছে। সংলগ্ন এলাকার পানি ব্যবহার, পরিবহন, ছাই নিঃসরণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়েও অসম্পূর্ণ মূল্যায়ন করা হয়েছে।
সুন্দরবন ও পশুর নদীকেন্দ্রিক জনবসতির ওপর এ প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে মূল্যায়নও অত্যন্ত দুর্বল বলে ব্যাংকট্র্যাক তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। প্রতিবেদনমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হলে এসব মানুষের বসতি ও জীবিকায় যে প্রভাব পড়বে, তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। পাশাপাশি পুনর্বাসনের বিষয়েও কোনো পরিকল্পনার উল্লেখ নেই প্রকল্প মূল্যায়নে। সর্বোপরি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বিষাক্ত দ্রব্য পরিবহন ও কয়লাভিত্তিক শিল্পায়নের ফলে সামগ্রিক পরিবেশের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নির্ধারণেও ব্যর্থ হয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা।
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (ছাড়পত্র) সৈয়দ নাজমুল আহসান এ প্রসঙ্গে বলেন, যথাযথ মানদণ্ড অনুসরণ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কারণেই ইআইএ অনুমোদন করা হয়েছে। এছাড়া ইআইএ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ৫৯টি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এসব শর্তের ব্যতিক্রম হলে ইআইএ বাতিল করতে পারবে পরিবেশ অধিদফতর।
বেশকিছু বিষয় নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে ব্যাংকট্র্যাক।
তারা বলছে, রামপালের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সুন্দরবনের ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রকল্প সম্পর্কে নানা তথ্য, মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল ইউনেস্কো ও রামসার সচিবালয়। এসব অনুরোধের কোনোটিতেই সাড়া দেয়নি প্রকল্প কার্যালয়। এছাড়া একটি দুর্লভ প্রাকৃতিক প্রতিবেশ হিসেবে সুন্দরবনের ওপর প্রকল্পটির পরিমাপযোগ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করার কথা থাকলেও করা হয়নি তাও।
তথ্যমতে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ৮৫ কিলোমিটার নদীপথে পরিবহন করতে হবে নির্মাণসামগ্রী। প্রতি বছর চার শতাধিক জাহাজ এ পথেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কয়লা পরিবহন করবে। এতে সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার পানি দূষিত হবে বলে জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া চালু হওয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত উষ্ণ পানির কারণে সুন্দরবনে স্বাদু পানির বাস্তুসংস্থানের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে।
প্রশ্ন উঠেছে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ নিয়েও। ব্যাংকট্র্যাকের প্রতিবেদন বলছে, যে প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাতে আইএফসির মানদণ্যের ব্যত্যয় ঘটেছে। প্রকল্পটির জন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় জমি অধিগ্রহণ ও সংশ্লিষ্টদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়নি।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণকাজ এগিয়ে নিচ্ছে বিআইএফপিসিএল। ঠিকাদার নিয়োগ দিতে এরই মধ্যে দরপত্রও আহ্বান করেছে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে গঠিত এ কোম্পানি।
বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের এনটিপিসি যৌথভাবে বিআইএফপিসিএল গঠন করে ২০১৩ সালে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ শতাংশ সমানভাবে অর্থায়ন করবে পিডিবি ও এনটিপিসি। বাকি ৭০ শতাংশ ঋণসহায়তা নেয়া হবে। সম্ভাবত্য যাচাই প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ২০১ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এর ১৫ শতাংশ বা ৩০ কোটি ২১ লাখ ৮৪ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রামপালের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।
সূত্র – বণিক বার্তা, প্রতিবেদক – মহিউদ্দিন নিলয় ও সুমন আফসার।